সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫

আবার তোরা 'লাভার' হ

জুনায়েদ আজীম চৌধুরীজুনায়েদ আজীম চৌধুরীপ্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে বাবু দার্শনিক হয়ে গেল। তার দার্শনিকতার প্রথম প্রকাশ দেখা গেল ফেসবুকে। তার স্ট্যাটাসগুলো হঠাৎ এ রকম হয়ে গেল—‘জীবন এক রেলগাড়ি, নেই কোনো স্টেশন।’ অথবা ‘উড়ে গেছে পাখি...আজ একা একা থাকি!’ ইত্যাদি। টংদোকানে চা খেতে বসলে সে থম মেরে তাকিয়ে থাকে একদিকে। মাঝেমধ্যে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে। আমরা প্রশ্ন করি, ‘বাবু, চা খাবি?’
বাবু একটা দীর্ঘ নিশ্বাসের সঙ্গে জবাব দেয়, ‘কী হবে চা খেয়ে!’
অত্যন্ত দার্শনিকসুলভ উত্তর। আমরা খুবই আনন্দিত হই। আমাদের বন্ধুমহল প্রতিভাহীন। অভিভাবকেরা আমাদের দিকে তাকিয়ে নাক সিঁটকান। বলেন, ‘তোদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না!’
বাবু যদি দার্শনিক হয়েই যায়, তাহলে বুক ঠুকে বলতে পারব, ‘দেখো, আমাদের মধ্যে একজন দার্শনিক হয়েছে! দার্শনিক...ফিলোসফার! সহজ কোনো ঘটনা না!’
তা ছাড়া বাবু যদি খুব বড় দার্শনিক হয়েই যায়, তাহলে তার খ্যাতিতে আমরাও কম খ্যাত হব না। সাংবাদিক আসবে আমাদের কাছে। বাবুর শৈশব-কৈশোর নিয়ে প্রশ্ন করবে। বাবু কেমন করে ভাবত, কখন ভাবত, ভাবতে ভাবতে আসলে কী ভাবত—এসব প্রশ্ন করবে। আমরা বলব, ‘বাবুর আসলে জন্মই হয়েছিল দার্শনিক হওয়ার জন্য। সে হাঁটতে হাঁটতে ভাবত, ক্লাসের মধ্যে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবত আর সবচেয়ে বেশি ভাবত বাথরুমে। একবার বাথরুমে ঢুকলে আর বেরোতেই চাইত না!’
আমরা ভাবছিলাম এসব কথা যদি কোনো সাংবাদিক আমাদের জিজ্ঞেস না-ও করে তাহলে ‘ফিলোসফার বাবুকে যেমন দেখেছি’ এ রকম নামে আমরা একটা বই লিখে ফেলব। পরবর্তী সময়ে বই লিখতে হতে পারে ভেবে আমরা সবাই মিলে বাবুকে গভীর পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম। আর তখনই ব্যাপারটা খেয়াল করলাম। ব্রেকআপের পর থেকে বাবু একা একা বিড়বিড় করছে। আর কিছুক্ষণ পর পর নিজের ফোনটা দেখছে। বিড়বিড় করে বলছে, ‘হিমা, অ্যানসার মি, হিমা! অ্যানসার মি!’
আমরা ভড়কে যাই। বাবু কী দার্শনিক না হয়ে পাগল হয়ে যাবে? ঠিক আছে কবি-দার্শনিকেরা একটু পাগলই হয়; কিন্তু ওসব কিছু না হয়ে সোজা পাগল হয়ে গেলে তো মুশকিল!
আমাদের সব মুশকিলের একমাত্র সমাধান মনু ভাই। তিনি হলেন ছোটদের অনন্ত জলিল। আমাদের মনে হয় অনন্ত জলিলের মতোই অসম্ভবকে সম্ভব করাই তার কাজ। আমরা বাবুকে নিয়ে ছুটলাম তার বাসায়। বললাম, ‘ভাই, বাবুকে বাঁচান। তার জিএফকে তার কাছে ফিরিয়ে দেন!’
মনু ভাই ভ্রু কুঁচকালেন, ‘জিএফ?’
শান্ত বলল, ‘জিএফ ভাই, জিএফ...গার্লফ্রেন্ড! বাবুকে ছ্যাঁকা দিয়া নাই!’
বাবু ছলছল চোখে তার করুণ ঘটনা বর্ণনা করল। বলল, ‘আমি ওকে বলছিলাম, যদি তুমি সত্যি আমাকে ভালোবাসো তাহলে আটটা স্টার এসএমএস করো...’
‘করে নাই?’
‘না। উল্টো ফোন অফ করে দিছে। আর ধরে না। আমরা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, পরপর তিন দিন কোনো যোগাযোগ না থাকলে আমাদের ব্রেকআপ! সাত দিন পার হয়ে গেছে! হিমা আর আমার লাইফে নাই! সে আর আমাকে ভালোবাসে না!’
‘তোমাদের ভালোবাসা কোনো ভালোবাসা হলো? ফেসবুক আর মোবাইল ফোনের ভালোবাসা! ভালোবাসা ছিল আমাদের সময়ে। তখন কোনো জিএফ-বিএফ ছিল না। ছিল লাভার। আমরা ছিলাম লাভার! জিএফ...এটা কোনো নাম হলো?’
শান্ত বলল, ‘নামে আর কী আসে যায়...শেক্সপিয়ারই বলেছেন...’
মনু ভাই অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘সব সময় ফটর ফটর করে কথা বলবে না। জিএফ-বিএফ আর লাভারের মধ্যে পার্থক্য আছে। লাভাররা হলো রিয়েল প্রেমিক। প্রেমিকার জন্য সব করতে পারে। প্রেমিকাকে বাসা থেকে কলেজ পৌঁছে দেওয়া...কলেজ থেকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া ছিল লাভারের নিয়মিত কর্তব্য!’
‘আমরাও তো দিই!’
‘তোরা তো তোদের জিএফদের সঙ্গে সব সময় কথা বলার সুযোগ পাস। আমাদের শুধু চোখাচোখি হতো। কোনো কথা না!’
‘কথা না হলে কীভাবে বুঝতেন সে আপনাকে পছন্দ করত?’
‘বোঝা যেত! তোদের মতো ফেসবুকীয় প্রেম ছিল না, তাই ইমোশন ঠিকই বোঝা যেত! তখন চোখে কথা হতো, মুখে মুচকি হাসি থাকত। বিকেলবেলা তাদের বাড়ির সামনে সাইকেল নিয়ে দাঁড়ালে ছাদে এসে দাঁড়াত...জানালায় হেলান দিত! আর আমরা একই রাস্তা দিয়ে সাইকেল নিয়ে ঘুরতেই থাকতাম ঘুরতেই থাকতাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না সন্ধ্যা হতো! হয়তো তিন মাস কেটে গেছে, আমাদের তখনো কথাই হয়নি!’
‘তাইলে কথা ছাড়া নির্বাক চলচ্চিত্রের মতো প্রেম চলত?’
‘নির্বাক কিন্তু অনেক কথা বলতাম আমরা চিঠিতে! আমাদের ভাষা ছিল চিঠি। আমরা লম্বা লম্বা চিঠি লিখতাম। চিঠি লেখার ভাষা শেখার জন্য পড়তাম মোটা মোটা বই। বই থেকে কোট করতাম। আর তোরা? তোরা গুগলে সার্চ দিয়ে দু-একটা রোমান্টিক লাইন বের করে ফেসবুকে ইনবক্স করে দিস...এভাবে প্রেম টেকে?’
বাবু খুবই কাতর গলায় বলল, ‘তাইলে কী করব?’
‘চিঠি লেখ। চিঠিতে মনের সব কথা জানা। তাকে যে কেমন আছাড়ি-বিছাড়ি ভালোবাসিস, তা বল! নইলে সে জানবে কী করে? আমি তো তোদের ভাবিকে চিঠি লিখেই পটিয়েছিলাম। কী দারুণ লিখতাম! এক সঙ্গে ছাপলে উপন্যাস হয়ে যাবে...! আরে জিএফ-বিএফ ছাড়! আবার তোরা লাভার হ! লাভার! আমার মতো লাভার হ!’
ঠিক এ সময় ভাবি ঢুকলেন ঘরে। আমরা সালাম দিতে গেলাম, কিন্তু ভাবি আমাদের খেয়ালই করলেন না। মনু ভাইকে বললেন, ‘তোমাকে না বলছিলাম আলু আনতে?’
‘আহা যাচ্ছি তো! ছোট ভাইরা আসছে...আমাদের লাভস্টোরিটা শোনাচ্ছিলাম আরকি...বলছিলাম কেমন লাভার ছিলাম আমি!’
‘কেমন লাভার মানে কী? তুমি ছিলে অত্যন্ত ভ্যাবদা লাভার! আমার সঙ্গে প্রথম কথা বলতে তুমি লাগিয়েছিলে পাক্কা দেড় বছর। বেকুবের মতো শুধু পেছন পেছন ঘুরতে; আমি যেখানে যেতাম সেখানেই, অথচ কথা বলতে পারো না! এখনকার ছেলেমেয়েদের দেখ, কত্ত স্মার্ট! দেখা হলো, পছন্দ হলো, বলে দিল আমি তোমাকে পছন্দ করি! আর এইটা বলতে কি না, তুমি লাগিয়েছিলে দেড়টা বছর! গাধার গাধা একটা!’
‘কী বল এত তাড়াতাড়ি বলে ফেলবে?’
‘বলবে না? তিন বছর ধরে ঘুরে শুধু “আই লাভ ইউ”ই যদি বলে তাহলে প্রেমটা করবে কখন? ঘুরবে কখন? এক সঙ্গে কফি খাবে কখন? প্রেমটা বুঝবে কখন?’
‘এদের তো শুধু ফেসবুক! চিঠি না লিখলে প্রেমের বুঝবে কী? আমি তোমাকে কত দারুণ দারুণ চিঠি লিখতাম...’
‘তুমি লিখতে? আমি জানি না ওই চিঠি কে লিখে দিত? ওই চিঠি লিখত তোমার চাচাতো ভাই। সে লিখত তার লাভার মিতুর জন্য। তুমি সেখান থেকে কপি করতা! মিতু তো আমার মামাতো বোন...আমরা দুজন মিলে বসে বসে তোমাদের দুজনের চিঠি মেলাতাম আর হাসতাম! তারপর দুজন মিলে একই উত্তর লিখতাম তোমাকে আর তোমার চাচাতো ভাইকে!’
মনু ভাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, ‘এইটা কী বললা তুমি? এই ঘটনা তুমি জানো?’
‘জানি না আবার! তুমি ছিলে এক গাধা লাভার, তোমার চাচাতো ভাই ছিল আরেক গাধা...’
মনু ভাই আর ভাবির কথোপকথন শুনতে শুনতে আমরা কনফিউজড। আবার আমরা লাভার হব নাকি জিএফ-বিএফ থেকে যাব? এ সময় বাবুর ফোনে এল তার জিএফ বা লাভারের টেক্সট, ‘স্যরি স্যরি স্যরি...এত্তগুলা স্যরি আমার বাবুটা! ফ্যামিলি ট্যুরে দুম করে ভুটান গেছিলাম। তোমাকে জানানোর সুযোগ হয়নি। স্যরি আমার, বাবুটা!’
বাবু হেসে ফেলল। আমরাও হেসে বললাম, ‘দে, একটা কড়া করে রিপ্লাই।’
বাবু কোমল গলায় বলল, ‘না, আজকে একটা চিঠিই লেখি...একবার লাভার হয়ে দেখি!’

প্রথম প্রকাশ- রস+আলো
লিংক: http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/711907/%E0%A6%86%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A6%BE-%E2%80%98%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E2%80%99-%E0%A6%B9

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন