রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

ফেসবুকের মতো ভালোবাসা

আঁকা: ষুভআঁকা: ষুভএক দেশে, যেমন থাকে, তেমনি ছিলেন এক রাজা।
রাজা খুব প্রফুল্ল চিত্তের—কথায় কথায় হাসেন। রাজার অনেক সুখ। এই সুখের উৎস তাঁর তিন কন্যা। তিন কন্যাই রাজাকে খুব ভালোবাসে। বড় কন্যা রাজার মাথার চুলে বিলি কেটে দেয় আর মেজো কন্যা রাজার চুলে দেয় কলপ করে। ছোট কন্যাটা অবশ্য একটু অন্য রকম। রাজার পাশে পাশে থাকে ঠিকই; কিন্তু সারাক্ষণই সে ঘাড় গুঁজে থাকে তার মোবাইল ফোনে। রাজা বলেন, ‘কী করিস তুই মাথা নিচু করে?’
: ফেসবুক দেখি, বাবা।
: ফেসবুকে কী আছে? আয়, আমার কাছে আয়!
রাজকন্যা রাজার কাছে যায়। কিন্তু তখনো সে তাকিয়ে থাকে তার স্মার্টফোনের দিকেই। রাজা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলেন। মনে মনে ভাবেন, এই ছোট মেয়েটা কেমন যেন হয়ে গেল! মেয়েটা কি তাহলে তাঁকে ভালোবাসে না?
সন্দেহ বেশি দিন ধরে রাখতে পারেন না রাজা। একদিন বসেন পরীক্ষা নিতে। কোন মেয়ে তাঁকে কেমন ভালোবাসে, সেই পরীক্ষা!
আসে বড় কন্যা। রাজা জিজ্ঞেস করেন, ‘তুই আমাকে কেমন ভালোবাসিস, মা?’
কন্যা বলে, ‘আমি তোমাকে মাথার চুলের মতো ভালোবাসি, বাবা!’
রাজার মাথায় চুল কম। নিজের কেশ-বিরল মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রাজা হেসে ওঠেন। মাথার চুল যার যায়, সে-ই জানে চুল কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বড় কন্যা তাহলে তাঁকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে! রাজা খুশি হয়ে বড় কন্যাকে একটা বিএমডব্লিউ গাড়ি উপহার দেন।
এরপরে আসে মেজো কন্যা। রাজা খুশি খুশি মনে জানতে চান, ‘মা, তুই আমাকে কেমন ভালোবাসিস?’
মেজো কন্যা চটপট বলে, ‘তোমাকে তো বাবা আমি কলপের মতো ভালোবাসি!’
রাজা অত্যন্ত খুশি হন। তাঁর কেশ-বিরল মাথায় যে অল্প কটা চুল বাকি আছে, তার সবই ধবধবে সাদা। সেই চুল তো এই কলপেই কালো হয়ে থাকে। বৃদ্ধ রাজাকে কলপই তারুণ্য ফিরিয়ে দেয়। মেজো কন্যাকে রাজা খুশি হয়ে একটা চার্টার্ড প্লেন উপহার দেন।
রাজা এবার ডাকেন ছোট কন্যাকে। ছোট কন্যা স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আসে রাজার কাছে। রাজা বলেন, ‘মা, তুই আমাকে কেমন ভালোবাসিস?’
ছোট কন্যা মাথা না তুলেই চট করে বলে, ‘একেবারে ফেসবুকের মতো ভালোবাসি, বাবা!’
রাজা ভীষণ আহত হন। এই মেয়ের মাথায় ফেসবুক ছাড়া অন্য কিছু কি নেই? আহত চিত্তেই রাজা ছোট রাজকন্যাকে শাস্তি দেন। বড় মর্মান্তিক শাস্তি! নির্জন এক দ্বীপে দশ বছরের নির্বাসন।
ছোট কন্যাকে বিদায় দেওয়ার সময় রাজা বলেন, ‘তুই কি কিছু নিতে চাস সঙ্গে?’
রাজকন্যা বলে, ‘চাই। আমার স্মার্টফোন আর সেটার চার্জার!’
রাজা আরও একবার ধাক্কা খান। তিনি ভেবেছিলেন, মেয়েটা হয়তো নির্বাসনে না যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করবে। ‘বাবা’ বলে তাকে জড়িয়ে ধরবে। রাজাও তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে শাস্তি মওকুফ করবেন। কিন্তু তা নয়, সে চায় কিনা স্মার্টফোন আর চার্জার!
রাজার রাগ আরও বাড়ে। ছোট রাজকন্যাকে পাঠিয়ে দেন নির্বাসনে। মনে মনে বলেন, ‘আমার দুই কন্যাই যথেষ্ট! লাগবে না আমার ফেসবুকের মতো ভালোবাসা!’
রাজা বসেন সিংহাসনে। কিন্তু রাজার মুখে আর হাসি নেই। বেজার মুখে রাজকার্য করেন। করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠেন। শুধু ছোট রাজকন্যার কথা মনে পড়ে। সে যেন তাঁর সব আনন্দ নিয়ে নির্বাসনে গেছে। আহা রে, সেই মুখটা যদি আবার দেখতে পেতেন রাজা!
মন্ত্রী দিলেন বুদ্ধি। বললেন, ‘রাজা মশাই, রাজকন্যা তো সব সময় ফেসবুকেই থাকে। আপনিও একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলুন! তাহলেই তাকে দেখতে পাবেন!’
রাজা বলেন, ‘ফেসবুকে ছবিও দেখা যায় নাকি মন্ত্রী?’
: হ্যাঁ রাজা মশাই। ছবি দেখা যায়, মনের কথা লেখা যায়, দিন-দুনিয়ার সব খবর পাওয়া যায়! ফেসবুক বড় কাজের জিনিস!
: বলো কী!
রাজা একটু থমকে যান। ফেসবুক যে এত কাজের জিনিস, তা তো তিনি জানতেন না! মন্ত্রীর কথায় রাজাও একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে ফেললেন। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেন ছোট রাজকন্যাকে।
বাবাকে ফেসবুকে দেখে রাজকন্যাও খুব অবাক। শুরু হয়ে যায় মেয়ে-বাবার ফেসবুকে যোগাযোগ। রাজা স্ট্যাটাস দেন। মেয়ে সেই স্ট্যাটাসে কমেন্ট করে, লাইক দেয়। মেয়ের লাইক পেয়ে রাজা তো খুবই খুশি। মেয়ের লাইক পাওয়ার আশায় রাজা আরও ভালো ভালো স্ট্যাটাস খুঁজতে থাকেন। দারুণ কিছু মাথায় এলেই সেটা লেখেন ফেসবুকে। আর মেয়েটাও যেন তৈরি থাকে। সঙ্গে সঙ্গে তার লাইক পৌঁছে যায় রাজার স্ট্যাটাসের নিচে। রাজা মেয়েকে বলেন, ‘মা রে, তোকে তো এখন খুব দেখতে ইচ্ছা করছে...!’
মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট বাঁকানো সেলফি তুলে রাজাকে ইনবক্স করে। রাজার চোখে পানি চলে আসে। আবার মেয়ের এ রকম অদ্ভুত ভঙ্গির ছবি দেখে হেসেও ওঠেন রাজা।
রাজা হেসেছেন শুনে রাজ্যজুড়ে ধন্য ধন্য রব ওঠে। সবাই বলে, ‘ধন্য ছোট রাজকন্যা, ধন্য তার ফেসবুক!’
ওদিকে মেয়েও রাজাকে ছবি পাঠাতে বলে। রাজাও মেয়ের মতো ঠোঁট বাঁকিয়ে সিংহাসনে বসে ‘সিংহাসনফি’ তুলে পাঠান মেয়েকে। মেয়ে তো ‘এত্তগুলা’ খুশি!
রাজা আর ছোট রাজকন্যা ফেসবুকের মাধ্যমে সব সময় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে থাকে। কখন কী খেল, কখন কী ভাবল, কখন কী মনের অবস্থা—সব জানায় তারা। রাজা বলেন, ‘তোকে নির্বাসনে দিয়ে তো আমার বিরাট ভুল হয়ে গেছে! এখন এই বুড়া বয়সে বুড়া আঙুল দিয়ে মোবাইল ফোন চাপতে চাপতে জীবন যাওয়ার উপক্রম!’
মেয়ে ওদিক থেকে বিরাট একটা স্মাইলি পাঠায়। রাজা লেখেন, ‘তোকে আর নির্বাসনে থাকতে হবে না মা, চলে আয়...!’
কিন্তু লেখাটা পাঠানোর আগেই ফেসবুক বন্ধ হয়ে যায়। রাজা কোনোভাবেই আর লেখাটা পাঠাতে পারেন না। মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না। রাজা দশদিকে লোক পাঠান। কী হলো? হঠাৎ করে ফেসবুক বন্ধ হয়ে গেল কেন? কেউ কিছুই বলতে পারে না। রাজার আর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয় না। রাজার আর কিছুই ভালো লাগে না। তখন ছোট মেয়ের সেই কথাটা মনে পড়ে রাজার, ‘তোমাকে ফেসবুকের মতো ভালোবাসি, বাবা!’
রাজাও মনে মনে বলেন, ‘আমিও তোকে ফেসবুকের মতোই ভালোবাসি রে, মা! ফেসবুক চালু হলেই তোকে জানিয়ে দেব, তোর নির্বাসন শেষ! তখন ছুটতে ছুটতে চলে আসবি। আর তুই এলে আমরা দুজন মিলে একটা সেলফি তুলে ফেসবুকে আপ করব! সেই ছবির ক্যাপশন হবে ‘ফেসবুকের মতো ভালোবাসা!’
রাজা অপেক্ষা করেন। বন্ধ ফেসবুক নিশ্চয়ই খুব তাড়াতাড়ি চালু হবে!

প্রথম প্রকাশ- রস+আলো
লিংক: http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/698629/%E0%A6%AB%E0%A7%87%E0%A6%B8%E0%A6%AC%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A7%8B-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন