বুধবার, ১৬ মার্চ, ২০১৬

সংসদ সুখের হয় বিরোধীর গুণে

বড় মামা আরেকবার জিব বের করে চুকচুক করলেন। বললেন, ‘বিগ মিসটেক!’
আমরা যারা তাঁর ভাগনে-বাহিনী, তারাও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবটা এমন করলাম, যেন খুবই বুঝতে পেরেছি এই বিগ মিসটেকের কারণ। আসলে আমরা এর কিছুই জানি না। তবে মামা সকাল থেকেই এ রকম গম্ভীর মুখে বসে আছেন আর কিছুক্ষণ পরপর ‘বিগ মিসটেক’ বলে যাচ্ছেন। মামা বললেন, ‘এত বড় ভুল কী করে করলাম?’
‘কী ভুল মামা?’ জানতে চাইলাম আমরা।
: ইলেকশনে দাঁড়ালাম না! এবারের ইলেকশনে দাঁড়ালাম না!
: ইলেকশনে?
: হ্যাঁ, ছেলেবেলায় মানুষজনের কত রকমের শখ থাকে! কেউ ডাক্তার হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবে, কেউ বিজ্ঞানী হবে, আমি হতে চেয়েছিলাম এমপি! মেম্বার অব পার্লামেন্ট! ভেবেছিলাম, আমিও সংসদে যাব। ‘মাননীয় স্পিকার’ বলে কথা বলতে শুরু করব। দেশের-দশের কথা বলব...এলাকার মানুষজনের সেবা করব!
মামার এই শখের কথা শুনে আমরা খুবই উল্লসিত হলাম। মামা যদি এমপি হতে পারে, তা হলে আমাদেরও কম দাম না! আমরা হব এমপি মামার ভাগনে গ্রুপ! আমরা খুবই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা হলে মামা, দাঁড়ালেন না কেন? আমরা তো ছিলামই। আমরা মিটিং করে, মিছিল করে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চেয়েচিন্তে আপনার জন্য ভোট চাইতাম। আপনাকে পাস করাতামই করাতাম! কেন দাঁড়ালেন না, মামা?’
মামা মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘ভয়ে...ভয়ে দাঁড়াইনি!’
আমরা আকাশ থেকে পড়লাম, ‘ভয়ে দাঁড়াননি? কিন্তু কীসের ভয়ে? কার ভয়ে?’
মামা আরেকবার নিশ্বাস ফেললেন। সোফায় পা তুলে বসলেন। একবার রান্নাঘরের দিকে উঁকিও দিলেন। হয়তো দেখে নিলেন মামি কী করছেন। আমরা তাড়া দিয়ে জানতে চাইলাম, ‘কার ভয়ে, মামা? আমরা থাকতে কাকে ভয়?’
মামা বিড়বিড় করে বললেন, ‘আর কাকে, তোদের মামিকে!’
: মামিকে? কিন্তু মামিকে ভয় পাওয়ার সঙ্গে ইলেকশনে দাঁড়ানোর কী সম্পর্ক, মামা? মামি মামির জায়গায়, সংসদ সংসদের জায়গায়, তাই না?
মামা চোখ গরম করে বললেন, ‘সংসদ দেখেছিস কখনো?’
আমরা ইতস্তত করলাম। সত্যিই তো সংসদের ভেতরটা আমরা কখনো দেখিনি। টিভিতে লাইভ-টাইভও দেখিনি তেমন একটা। বললাম, ‘না মামা, দেখিনি।’
: তা হলে? জানিস ওখানে কী হয়? কত রকমের বিল পাস হয়, কত রকমের বক্তৃতা হয়? আর সেই সব বিল আর বক্তৃতা নিয়ে কত রকমের কথা-কাটাকাটি ঝগড়া-বিবাদ হয়, জানিস কিছু? হাত চাপড়ানো, ফাইল চাপড়ানো...কথায় কথায় উঠে দাঁড়ানো, চিৎকার চেঁচামেচি কত কী! সঙ্গে কথার মারপ্যাঁচ, বিরোধী দলের ওয়াকআউট... জানিস এসব?
আমরা মামার কথার লাইন ধরতে পারছিলাম না। বললাম, ‘না মামা, জানি না। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে মামির কী সম্পর্ক?’
মামা আরেকবার উঁকি দেন রান্নাঘরের দিকে। তারপর ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘আছে আছে, সম্পর্ক আছে! তোদের মামি...সে-ও তো ধর এক বিরোধী দল! সংসদে বিরোধী দল যেমন সবকিছুর বিরোধিতা করে, ঘরে তোদের মামিও তো তেমনি আমার সবকিছুতে বিরোধিতা করে। বিরোধী দল সংসদে টেবিল চাপড়ায় আর তোদের মামি থালাবাসন চাপড়ায়...সংসদে বিরোধী দল যেমন ওয়াকআউট করে, তোদের মামিও তেমনি ওয়াকআউট করে বাপের বাড়ি চলে যায়! গত দশ বছর তোদের মামির সঙ্গে সংসার করতে করতে বিরোধী দল নিয়ে আমার ভেতর ট্রমা তৈরি হয়েছে। বিরোধী দল মানে তোর মামিকে দেখলে আমার বুক ধকধকিয়ে ওঠে...মাথা ঝিমঝিমায়...কিছু একটা ভুল করলেই তোদের মামির মুখটা এমন করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে যে মনে হয় আমার হার্টের রিদম মিস হয়ে যাবে! আমি ভেবেছিলাম নির্বাচনে পাস করে সংসদে গেলে ঘরে আর সংসদে দুই-দুইটা বিরোধী দল আমি কী করে সামাল দেব! এক বিরোধী দলই যখন সারা জীবনের কান্না, তখন দুই বিরোধী দলে আমার কী অবস্থা হবে বুঝতে পেরেছিস?’
আমরা বুঝতে পেরেছি বলে মাথা ঝাঁকালাম। আসলেই মামিটা বিরোধী দল। মামাকে কেমন শক্ত শক্ত কথা শোনায়। মামির ভয়ে মামা সিগারেট খাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। তাতে অবশ্য মামারই লাভ হয়েছে! যা হোক, সবই বুঝলাম...কিন্তু এখন আবার বিগ মিসটেক বিগ মিসটেক বলে বুক চাপড়াচ্ছেন কেন? হঠাৎ কী হলো?
মামা আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর আরেকবার রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সংসার যেমন সুখের হয় রমণীর গুণে, তেমনি সংসদ সুখের হয় বিরোধী দলের গুণে! সংসদে এখন সুখ আর সুখ! পত্রিকায় খবর এসেছে, সংসদের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু ওখানে একবারও বিরোধিতা নেই বিরোধী দলের! যে বিল সরকারি দল পাস করাতে চেয়েছে সেই বিলই পাস হয়েছে। বিরোধী দল কিচ্ছু বলেনি! টেবিল চাপড়ায়নি, চিৎকার করেনি, ওয়াকআউট করেনি। কিচ্ছু করেনি! এই দুই বছরে বিরোধী দল কিচ্ছু করেনি! এর মানে বুঝিস তোরা?’
আমরা মাথা নাড়ালাম, ‘না।’
মামা বললেন, ‘এর মানে হলো সংসদ এখন সুখী সংসার! কোথাও কোনো ঝামেলা নেই, কোথাও কোনো বিবাদ নেই! আর আমার সংসার দেখ! উঠতে বসতে ভুল করি আর তোদের মামির ঝাড়ি খাই! আমি যদি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পাস করে সংসদে যেতে পারতাম তা হলে আর এই সংসারমুখী কখনো হতাম না! গৌতম বুদ্ধ সংসার ত্যাগ করে নির্বাণ লাভ করেছিলেন, আমি না হয় সংসার ত্যাগ করে সংসদে একটা পদ লাভ করতাম! সংসদে দাঁড়িয়ে আরাম করে বলতে পারতাম, ‘মাননীয় স্পিকার...’! মিসটেক রে, বিগ বিগ মিসটেক!
বড় মামা সত্যিই যে বিগ মিসটেক করে ফেলেছেন তাতে আমরাও সায় দিলাম। সত্যি এমন সুযোগ বিরল। আবার কবে আসবে কে জানে! তখন মামা নির্বাচন করতে পারবেন কি না, কে জানে! তত দিনে মামাকে তো সংসারের বিরোধী দল মানে মামিকেই সামলাতে হবে! মামাকে নিয়ে আমরা সত্যিই দুশ্চিন্তায় পড়লাম।
মামা বললেন, ‘সংসদে এবারের বিরোধী দল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে! এবার যদি আমার সংসারেও একটু সুখ আসে। তোরা তোদের মামিকে বল, সারা দিন সিরিয়াল না দেখে এক-আধটু যেন সংসদও দেখে!’
আমরা আকাশ থেকে পড়লাম, ‘কেন, মামি সংসদ দেখে কী করবে?’
: সংসদ দেখলেই না তোদের মামি বুঝতে পারবে বিরোধী পক্ষে থেকেও কত সহজ, শান্তিপূর্ণ, আর কিছু না করে দিন কাটানো যায়! তোর মামির ব্যাপারে এখন তো বিরোধী দলই ভরসা। বলবি তোরা একটু তোদের মামিকে?
আমরা বললাম, ‘অবশ্যই বলব, মামা। আপনার জন্য আমরা সব করতে পারি। আমরা তো আপনারই দলে!’
এমন সময় হঠাৎই মামির কণ্ঠস্বর ভেসে এল রান্নাঘর থেকে, ‘কই তুমি? তুমি না বললে, রান্নায় হেল্প করবে?’
মামির কণ্ঠ শুনেই মামা হঠাৎ হড়বড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ‘মাননীয় স্পিকার...মাননীয় স্পিকার! আমি এক্ষুনি আসছি...এক্ষুনি আসছি আমি!’
মামা ছুটে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। যাওয়ার আগে অবশ্য আরেকবার বললেন, ‘শোন, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে আর সংসদ সুখের হয় বিরোধী দলের গুণে, কথাটা তোরা মনে রাখিস!’
আমরা হয়তো মনেও রাখতাম! কিন্তু ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে বিরিয়ানির ঘ্রাণ ভেসে আসতে লাগল। আমরা সঙ্গে সঙ্গে দলবদল করে বিরোধী দল অর্থাৎ মামির দলে যোগ দিয়ে ফেললাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন