বুধবার, ১৬ মার্চ, ২০১৬

এই কাকাতুয়া লইয়া আমি কী করিব?

অাঁকা: তুলি: এই নাও তোমার কাকাতুয়া! এ রকম কাকাতুয়ার আমার দরকার নাই!
আমি মিলির দিকে তাকালাম। মিলির হাতে খাঁচা, খাঁচার ভেতর কাকাতুয়া। মিলির চেহারা হয়ে আছে কাকতাড়ুয়া। আমি বললাম, ‘হঠাৎ! কী হয়েছে?’
: কী হয়েছে মানে? মানুষ জন্মদিনে কত কী দেয়, আর তুমি দিলে কী—একটা কাকাতুয়া!
: আমি তো সবার মতো না! কাকাতুয়া একটা একসেপশনাল গিফট! তোমাকে রোজ কানের কাছে শোনাবে—মিলি, তোমাকে ভালোবাসি...মিলি তোমাকে ভালোবাসি!
: তাহলে তো ভালোই হতো। এই কাকাতুয়ার মুখে বাংলা কোনো শব্দ নাই। সারা দিন হিন্দি শব্দ আর হিন্দি আইটেম সংয়ে মাথাটা আমাদের আউলায় দিছে!
: কী বলছ! কাকাতুয়া হিন্দি বলছে!
: হ্যাঁ। তাকে যে বারান্দায় রাখা হয়, সেখান থেকে পাশের বাসার টিভি রুম খুব কাছে। আর ওই বাসায় সারা দিন হয় হিন্দি সিরিয়াল না হয় হিন্দি সিনেমা চলছে! এখন আমাদের ঘুম ভাঙে তোমার এই কাকাতুয়ার গানে!
: গান তো খুবই ভালো জিনিস! বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, সকালে গান মানুষকে সতেজ আর...
: রাখো তোমার সতেজ! কী গান গায় জানো?
মিলি আর কিছু বলার সুযোগই পেল না, কাকাতুয়াটা গেয়ে উঠল, ‘ইউ আর মাই ছাম্মাক ছাল্লো...ইউ আর মাই ছাম্মাক ছাল্লো!’
মিলি আমার দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে বলল, ‘বুঝতে পেরেছ? সেদিন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “ও কাকাতুয়া, তোমার নাম কী?” ও কী বলে জানো?’
: কী?
: তুমিই জিজ্ঞেস করে দেখো!
আমি কাকাতুয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘নাম কী তোমার?’
কাকাতুয়া চোখ পাকিয়ে বলল, ‘রিশতেমে হাম তুমহারা বাপ লাগতাহে, নাম হে কাকাতুয়া!’
আমি বিস্মিত। এ তো গড়গড় করে হিন্দি বলছে! মিলি করুণমুখে বলল, ‘অনবরত বলছে! তুমি তো জানোই, আব্বুর গায়ের রং একটু শ্যামলা। আব্বুকে দেখামাত্র এটা বলে ওঠে, “কিতনে আদমি থে কালিয়া! কিতনে আদমি থে কালিয়া!” আর আম্মু সামনে গেলেই বলছে, “পেয়ার কিয়া তো ডারনা ক্যায়া...পেয়ার কিয়া তো ডারনা ক্যায়া!” আব্বু ভীষণ খেপছে এটার ওপর! আর আব্বু এ-ও জানতে পেরেছে যে এই পাখিটা তুমি আমাকে দিয়েছ!’
: সর্বনাশ!
: আরও সর্বনাশ আছে! আব্বু বলেছে, যে ছেলের কাকাতুয়া এ রকম হিন্দি বকে, সে ছেলেও নাকি হিন্দি বকে! সারা দেশই নাকি হিন্দি বকাউল্লায় ভরে গেছে। আব্বু বলেছে, তোমাকে যেন বলি, এই কাকাতুয়াকে তুমি বাংলা শেখাবে!
: কী?
: হ্যাঁ। আমাকে বলেছে, ওই ছেলে যদি কাকাতুয়াটাকে বাংলা শেখাতে না পারে, তাহলে আমি যেন আর কোনো দিন তার চেহারা না দেখি!
: এসব কী বলো তুমি?
: ঠিকই বলছি। এবার বুঝতে পারছ তো তোমার একসেপশনাল গিফটের ফ্যাঁকড়া? হয় এটাকে বাংলা শেখাও, না হলে আমাকে ভুলে যাও!
মিলি গটগট করে চলে গেল। কাকাতুয়াটা বলে উঠল, ‘নিকাল গায়া নিকাল গায়া!’
মানুষ ভালোবাসার জন্য কত কীই–না করে। কেউ দৈত্যকে মেরে রাজকন্যা নিয়ে আসে, কেউ সাগর সেঁচে মুক্তা আনে, কেউ তাজমহল বানায়, কেউ রাজমহল বানায়, আবার কেউ কেউ বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়! কাকাতুয়াটাকে নিয়ে আমার উন্মাদ হওয়ার দশা হলো। শুরু হলো আমার কাকাতুয়াকে বাংলা শেখানো।
কিন্তু কী করে শেখাব বাংলা? আমি তার সামনে গিয়ে বলি, ‘ক...’
কাকাতুয়া বলে, ‘ক্যায়া?’
: ক! ক!
: ক্যায়া, ক্যায়া?
আমি নিশ্বাস ফেলি। কলবেল বাজলে কাকাতুয়া বলে, ‘মেহমান আয়া, মেহমান আয়া!’ তারপর একা একা সুর করে গান গায়, ‘বালাম পিচকারি, জো তুনে মুঝে মারি...’
আমি আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলি। হায় মিলি! কী কুক্ষণে তোমাকে এই উপহার আমি দিয়েছিলাম!
আমার মেসের রুমে টিভি নেই, বাংলা শেখাতে তাই চালু করলাম এফএম রেডিও। কাকাতুয়াকে বললাম, ‘খুব মনোযোগ দিয়ে শোনো! তোমাকে এগুলো বলতে হবে!’
কাকাতুয়াও ঘাড় বাঁকিয়ে প্রস্তুত। তখনই কোনো এক আরজে বলে উঠল, ‘হাই লিসেনারস, তোমড়া শুনবা একটা মাস্তিভরা ট্র্যাক, যেটা আমারও খুব হট অ্যান্ড হট ফেবারিট! সো, চলো রক করি আর স্মৃতির দুয়ারে নক করি অ্যান্ড সাথে সাথে আমাকে এসএমএস কড়তেও ভুল্লো না কিন্তু!’
আমি চট করে রেডিওটা বন্ধ করে দিলাম। এই বাংলা তো হিন্দির থেকেও ভয়ংকর! আমি আবার চেষ্টা করি। বলি, ‘বলো অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে...’
কাকাতুয়াটা বলে, ‘বেবি ডল মে সোনেদি...’
আমি বলি, ‘আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে...’
কাকাতুয়া হাই তুলে বলে, ‘মুঝে নিদ আয়া রাহাহে...’। বলেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি পড়লাম বিপাকে। জীবনে যে এমন যন্ত্রণারও মুখোমুখি হতে হবে, তা কখনো ভাবিনি। নিয়ে এলাম আমাদের বন্ধু পারভেজকে। পারভেজ কবিতা লেখে। কী লেখে আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু কঠিন কঠিন শব্দ যেহেতু থাকে তার কবিতায়, সেহেতু কবি হিসেবে তাকে আমরা গুরুত্ব দিই। বললাম, ‘পারভেজ, এখন তুই-ই ভরসা!’
: কোনো চিন্তা কোরো না, দোস্ত। আমার কবিতা শুনে পুরা জাতি ভাষা শিখতে আছে, তুমার একটা পাখি কোন ছার!
পারভেজ তার বিক্রি না হওয়া কবিতার বই নিয়ে কাকাতুয়ার সামনে বসল। শুরু করল কবিতা পড়া। গ্যাস বেলুন, হাহাকার, মস্তিষ্ক, নিরেট, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, চক্রাতিচক্র—ইত্যাদি শব্দ তার আবৃত্তিতে ঘুরেফিরে আসতে থাকল। এদিকে কাকাতুয়াটা আচানক জ্ঞান হারাল খাঁচার ভেতর একটা লাফ দিয়ে। মাথায় পানি-টানি ঢেলে কোনোরকমে তার জ্ঞান ফেরানো হলো। পারভেজ তার দ্বিতীয় কবিতাটা পড়তে যাবে, তখন বললাম, ‘থাক দোস্ত, তুই আর কিছু পড়িস না। তোর কবিতা শুনতে শুনতে আমারই কেমন বুক ধড়ফড় করে, মাথা ঝিমঝিম করে, আর ওটা তো সামান্য একটা কাকাতুয়া!’
পারভেজ চলে গেল। আমাকে ফেলে গেল অথৈ সমুদ্রে। আমার রুমের উল্টো দিকের রুমটায় থাকেন রাব্বি ভাই। রাব্বি ভাই নিজেকে গায়ক হিসেবে পরিচয় দেন। প্রতি সকালে উঠে দীর্ঘক্ষণ ‘আআআআআ’, ‘ওওওওওও’ প্রভৃতি করে খুব কর্কশ স্বরে রেওয়াজ করেন। আমি ভাবলাম, কবিতায় যদি না হয়, তাহলে গানই তো একমাত্র ভরসা!
রাব্বি ভাই বিপুল উৎসাহে রাগ-বিরাগ শুরু করলেন আর কাকাতুয়া ঝিমাতে শুরু করল। অবস্থা বেগতিক দেখে রাব্বি ভাইকেও বিদায় দিলাম। বুঝলাম, মিলির সঙ্গে আমার ব্রেকআপ হতে আর দেরি নেই!
এ রকম সময়ে মেসে আগমন ঘটল আরেকটা কাকাতুয়ার। হিমেল ভাই কাকাতুয়াটা পেয়েছে তার ফুফুর বাসা থেকে। আমার কাকাতুয়াটা নতুন কাকাতুয়াটাকে দেখে ভীষণ খুশি। সে হিন্দিতে তাকে নানা রকম কথা বলে। কিন্তু নতুন কাকাতুয়া হিন্দি জানে না বলেই মনে হলো। নতুন কাকাতুয়াটা বাংলায় বলল, ‘কী?’
আমার কাকাতুয়াটা গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর বলল, ‘ভালোবাসি ভালোবাসি!’
নতুন কাকাতুয়াটাও তখন বলল, ‘ভালোবাসি ভালোবাসি!’
আমরা মুগ্ধ হয়ে দুই কাকাতুয়ার বাংলা কথোপকথন শুনতে থাকলাম। মিলির সঙ্গে বোধ হয় আর আমার ব্রেকআপটা হলো না!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন