সোমবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৮

এক যে ছিল দুই


এক যে ছিল দুই। শরীরটা বাঁকানো, কিন্তু মনটা ভীষণ সরল। আর সরল মন হলে যা হয়, দুইয়ের মনে ভীষণ দুঃখ। দুঃখটা হলো সেসব সময় দ্বিতীয় হয়। প্রথম হয় এক। এককে তাই দুইয়ের ভীষণ হিংসা। দুই যদি এক হতো! আহা, কী মজাটাই না হতো! দুই তাহলে সব সময় প্রথম হতো। সবার আগে দুইকে ডাকা হতো।
দুই ভাবল, এটা এখনো হতে পারে। হতে পারে যদি এক না থাকে।
দুই ঠিক করল, এককে বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেবে। আর তাই দুই চলল একের সন্ধানে।
যেতে যেতে যেতে বনের মধ্যে দেখল বিরাট একটা ড্রাগন। ড্রাগনের চোখে আগুন। ড্রাগনের নাম হুতাশন। হুতাশন বলল, ‘শোনো দুই, এককে হারানো খুব কঠিন কাজ! কারণ এক হলো এক! সে সবকিছুতেই এগিয়ে থাকে!’
দুই বলল, ‘তাতে কী? আমিও ফার্স্ট হব! আমি ছড়া বলতে পারি, নামতা গুনতে পারি!’
হুতাশন বলল, ‘এগুলো পারলে তো হবে না শুধু! যুদ্ধও পারতে হবে! একের আছে একচোখা দৈত্যের বিরাট বাহিনী!’
মনটা দমে গেল দুইয়ের। হুতাশন বলল, ‘তবে চিন্তা নেই। আমি তোমাকে আমার ক্ষমতা দিয়ে দিচ্ছি।’ বলেই হুতাশন দুইয়ের চোখে হাত বুলিয়ে দিল। দুইয়ের চোখটা যেন কেমন করে উঠল। হুতাশন মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘এখন চাইলেই তুমি তোমার চোখ দিয়ে আগুন বের করতে পারবে!’
দুইয়ের বিশ্বাস হলো না। কিন্তু একটু কটমট করে তাকাতেই তার চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল আগুন। দুইয়ের খুশির সীমা নেই।
এবার দুই চলল এককে ধরতে। কিন্তু কিছু দূর যেতে না যেতেই সে পথ হারিয়ে ফেলল। যাওয়ার কথা পাহাড়ে, গেল সে সমতলে। চারদিকে শুধু নীল নীল গাছ। গাছের মাথায় লাল লাল ফুল। আর সেসব নীলগাছের ভেতর থেকে ছুটে আসতে থাকল একটা বেবুন...না একটা হাতি...না একটা ময়ূর...সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত প্রাণী। দুইকে দেখেই প্রাণীটা জাপটে ধরে বলল, ‘তুই আমার দোস্ত!’
দুই অবাক হয়ে বলল, ‘দোস্ত? কিন্তু আমি তো তোমাকে চিনিই না!’
প্রাণীটা বলল, ‘এখন চিনে নাও। আমার নাম বেহাহাম!’
‘বেহাহাম? এটা আবার কেমন নাম?’
‘খুবই ভালো নাম। বেবুনের বে, হাতির হা, আর ময়ূরের ম মিলিয়ে নাম বেহাম!’
‘কিন্তু আরেকটা হা? সেটা কীসের জন্য?’
সঙ্গে সঙ্গে বেহাহামের চোখ জ্বলে উঠল। নাকের ওপর পড়ল ভাঁজ। দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘সেটা এই হায়েনার জন্য!’
এবার বেহাহামের শরীরে হায়েনার চিহ্ন। ঝাঁপিয়ে পড়ল দুইয়ের ওপর। বলল, ‘কত্ত দিন কিচ্ছু খাই না! এবার তোকে আমি খাব দোস্ত!’
দুই ছুটল প্রাণভয়ে। কিন্তু পারল না। তাকে জাপটে ধরে ফেলল বেহাহাম। হাঁ করে যেই না বেহাহাম দুইকে খেতে যাবে, অমনি দুই শক্ত চোখে তাকাল বেহাহামের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল আগুন। ঝলসে গেল বেহাহামের মুখ। কেঁপে উঠল বেহাহাম। চিৎকার করে বলল, ‘পুড়ে গেলাম পুড়ে গেলাম...মরে গেলাম রে! একবার আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছে এক...আর এবার আমাকে পুড়িয়ে মারল দুই!’
একের কথা শুনে দুই তাড়াতাড়ি বেহহামকে বলল, ‘এক কে তুমি চেনো? কোথায় আছে এক?’
বেহাহাম মুখের আগুন নিভিয়ে বলল, ‘জানি। কিন্তু তুমি যদি কথা দাও আমাকে আর পোড়াবে না, তাহলেই শুধু বলব এক কোথায়।’
‘আর পোড়াব না!’
‘অমুক পাহাড়ে তমুক মাথার সমুক গুহায় থাকে এক। ওখানে কেউ যায় না একচোখা দৈত্যগুলোর ভয়ে।’
দুই বলল, ‘আমি যাবই!’
চলল চলল চলল দুই! অনেক অনেক দিন পথ চলল দুই!
তারপর একদিন দেখা মিলল অমুক পাহাড়ের। সেখানে খুঁজতে খুঁজতে তমুক মাথা আর সমুক গুহাও পেয়ে গেল এক। ব্যস, আর কোথায় যায়! দুই ছুটল সেই গুহায়। কিন্তু গুহার কাছে যেতেই দেখল কে যেন চুপচাপ বসে আছে ঝরনার পাশে। কাঁদছে পিঠ ফুলিয়ে। মনটা খারাপ হলো দুইয়ের। বলল, ‘এই যে, তুমি কাঁদছ কেন? মা বকেছে?’
সে মাথা নাড়াল। দুই এগিয়ে গেল। বলল, ‘কে তুমি? কী করো এখানে? কেন কাঁদছ?’
সে বলল, ‘আমি এক। আর আমি খুব একা তো তাই কাঁদছি!’
দুই অবাক। বলল, ‘তুমি এক? তুমি একা?’
‘হুম। সবাই মনে করে সব সময় প্রথম হই বলে আমার বোধ হয় খুব অহংকার! সবাই ভাবে আমার অনেক একচোখা দৈত্য আছে! আসলে কী জানো, আমার ওসব কিচ্ছু নেই। আর আমি চাই সবাই আমার কাছে আসুক, আমার সঙ্গে খেলুক! কিন্তু কেউ আসে না, জানো! আসলে কেউ আমাকে ভালোবাসে না।’
দুইয়ের মনটা একের জন্য খুব খারাপ হলো। এত কষ্টে থাকে এক! এই কষ্টের কাছে তো দুইয়ের কষ্ট কোনো কষ্টই না! দুই এবার একের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমি দুই! আজ থেকে তুমি আর একা থাকবে না এক...আজ থেকে তোমার বন্ধু হলো দুই!’
এক ভীষণ অবাক হয়ে দুইয়ের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে ফেলল। বলল, ‘সত্যি আমরা বন্ধু?’ দুই মাথা নাড়াল।
আর এরপর থেকে এক আর দুইয়ের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গলে চিরদিনের জন্য।

সোমবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৭

যে কারণে আমি কপিরাইটার

ইচ্ছা ছিল, আমি হব পাইলট।
পাঁচ-ছয় বছর বয়সে কেউ জানতে চাইলে কিংবা না চাইলে আমি ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতাম, ‘বড় হলে আমি পাইলট হব।’ আমার ধারণা ছিল, আকাশ যেহেতু ফাঁকা, রাস্তার কোনো বালাই নেই, ফলে প্লেন চালানো নিশ্চয়ই একটা সহজ ব্যাপার হবে। ফলে যে বয়সে অন্যরা হাফ প্যাডেলে সাইকেল চালানো শিখছে, সে বয়সে আমি কাগজের প্লেন বানিয়ে তা উড়িয়ে বেড়াচ্ছি।
প্লেন চালানোর সাধে আমার সাইকেল চালানো শেখা হলো না। আমার বন্ধুবান্ধব এমনকি আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত এ নিয়ে যখন হাসাহাসি শুরু করল, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, পাইলট হতে পারি না-পারি, প্লেন চালাতে পারি আর না-পানি, সাইকেল আমাকে চালাতে পারতেই হবে।
বয়স তখন একটু বেড়ে গিয়েছিল, হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরেছি, তার সঙ্গে চুলে নিজস্ব স্টাইলে সিঁথি করা ধরেছি। এত কিছু ধরাধরির মধ্যে নতুন করে আর সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরতে পারলাম না। একবার অবশ্য চেষ্টা করেছিলাম। প্যাডেলে চাপ দিয়ে রাস্তার দিকে যেই না এগোতে যাব, তখন দেখি, পাশের ড্রেনটা লাফিয়ে আসবি তো আয় আমার সাইকেলের নিচেই চলে এল! আমি ধপাস! আকাশে তখন শুধুই চিল উড়ছিল। সেদিনই বুঝতে পারলাম, রাস্তায় সাইকেল চালানোর মতোই আকাশে প্লেন চালানো নিতান্তই প্রকৃতিবিরুদ্ধ এক ব্যাপার। অতএব, পৃথিবীতে পাইলট হওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই!
এরপরই আমার মাথার ভেতর ভূত চাপল ক্রিকেটের। ভূত এ জন্য যে খেলাটা আমি দারুণ ভালোবাসতাম। কিন্তু খেলাটা আমাকে ভালোবাসত না। আমরা মহল্লার যেখানে খেলতাম, তার আশপাশের একাধিক বাসার বারান্দা কিংবা জানালায় দর্শক হিসেবে থাকত তরুণী আর কিশোরীরা। তাই আমি মাঝেমধ্যেই ক্রিকেট মাঠে নায়ক হয়ে উঠতে চাইতাম। কিন্তু না পারলাম একটা ছক্কা হাঁকাতে, না পারলাম বোল্ড করে একটা উইকেট দখল করতে! তবে খেলাটা বেশ ভালো বুঝতে পারার কারণে কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে সবাই মিলে আম্পায়ার বানিয়ে দিতে চাইল। মাঠে গেলেই দুই দল ভাগ হয়ে আমাকে কয়েন বাড়িয়ে দেয়! আমি ‘কয়েনের খ্যাতাপুড়ি’ বলে ফিরে আসি সেই মাঠ থেকে চিরতরে। আমার ইচ্ছা ছিল মাশরাফি হওয়ার, আর ওরা কিনা আমাকে বানাতে চায় আলিম দার!
হাইস্কুল থেকে কলেজের প্রত্যেক শিক্ষক আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন। হবে না, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না! আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও হতাশা। ছেলেটা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারল না। অবস্থা যখন চরম খারাপ, দশ দিক থেকে যখন হাহাকার ভেসে আসতে শুরু করল, তখন ঠিক করলাম, আমি একটা ব্যান্ড করব। ব্যান্ডের নাম হবে ‘বায়স ব্যান্ড’। এ কথা দু-একজনকে বলতেই তারা ব্যান্ডে আগ্রহী না হয়ে ব্যান্ডের নাম নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ল। বারবার জানতে চাইল ‘বায়স’ মানে কী! আমি ‘কাক’ বলতেই তারা হাসল। বলল, ‘তোর যা গলা, তাতে নাম ঠিক আছে!’
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’ আমিও একলা চলা শুরু করলাম। রেওয়াজ ছাড়া গান সম্পন্ন হয় না। আমি সকাল-বিকেল সম্ভব হলে রাতেও রেওয়াজ শুরু করলাম। তিন দিনের মাথায় পাড়ার মানুষেরা আমার বাড়িতে চড়াও হলো। বাবা-মাকে স্পষ্ট জানিয়ে গেল, হয় আমার রেওয়াজ বন্ধ করতে হবে, নাহয় আমার বিরুদ্ধে সালিস বসবে। আমি রেওয়াজ ছেড়ে দিলাম। আমার বায়স ব্যান্ড ছেড়ে দিলাম। গিটার কিনব ভেবে যে টাকাটা জমাচ্ছিলাম, সেটা দিয়ে ছিপ-বড়শি কিনে পুরোদস্তুর মৎস্যশিকারি হয়ে উঠলাম।
ঠিক এ রকম সময়েই আমার জীবনে এল হিমেল। হিমেল এল তার নতুন প্রেমের পুরোনো সমস্যা নিয়ে। এক বছরের জুনিয়র এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে সে। কিন্তু কীভাবে প্রপোজ করবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটার জন্য একটা চিঠি লিখে দিতে হবে আমাকে। এমন করে লিখতে হবে, যেন মেয়েটা ‘না’ করতে না পারে। আমি আমড়া কাঠের ঢেঁকি। হিমেলের শুকিয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে, একটা সপ্তাহ সময় দে।’
এই এক সপ্তাহে হাতের কাছে যা আছে পড়ে ফেললাম। হুমায়ূন আহমেদ থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ! সুনীল থেকে এমনকি কঠিন কঠিন লাইনের নজরুল পর্যন্ত! অষ্টম দিন চিঠি লিখলাম হিমেলের হয়ে—অত্যন্ত সাহিত্যরসে ভরা চিঠি। কোনো লাইনই অবশ্য আমার নয়। একেকটা লেখকের একেকটা লাইন স্ট্রেট বসিয়ে দিলাম।
ফল হলো ভয়ানক! নবম দিনে হিমেলের সঙ্গে আমাকে এবং আমার লেখা চিঠিটা নিয়ে এলাকার অভিভাবকেরা বসলেন। ভরা বাজারে আমার লেখা চিঠিটা উচ্চস্বরে পড়ে শোনানো হলো। সবাই বিস্তর হাসাহাসি করল। মেয়ের বাবা বললেন, ‘এমন ইতরমার্কা চিঠি কেবল হীরকই লিখতে পারে!’ বলা বাহুল্য, হিমেলকে দুইটা ধমক দিলে সে জানিয়ে দিয়েছিল যে চিঠিটা আমিই লিখেছিলাম। দশবার কান ধরে ওঠ-বস আর ‘এমন গর্হিত কাজ কখনো করব না’—এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিনের মতো মুক্তি পেয়েছিলাম। আর ভেবেছিলাম, আমার পত্রলেখকের কাজ বোধ হয় এখানেই শেষ। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, তারপর থেকে গোপনে সবাই আমার কাছে আসতে শুরু করল! হিমেলকে যেমন ঝাকানাকা চিঠি লিখে দিয়েছি, তেমন যেন লিখে দিই। আমি জীবনানন্দ দাশের কবিতা, হুমায়ূন আহমেদের হিমুগিরি, আর সুনীলের সুখব্যথা মেরে মেরে চিঠি লিখতে শুরু করলাম।
সেই লেখা আজও থামেনি। মজার ব্যাপার, কেউ কেউ আমাকে এখন রাইটার বলেন। আমি তাদের ভুল শুধরে দিই; বলি, আমি একজন কপিরাইটার!


রস+আলোয় প্রকাশিত

রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭

ইচিং বিচিং

অলংকরণ: তুলি

ইচিং বিচিং দুই ভাই। শুয়ে ছিল কড়ইয়ের ডালে। পায়ের ওপর ঠ্যাংটা তুলে ভাবছিল আজ কী খাওয়া যায়! কলা খেতে খেতে জিভের স্বাদ কলার খোসার মতো হয়ে গেছে!
ইচিং বলল, চল, আজ নতুন কিছু ট্রাই করি! আজ থেকে আমরা মানুষের খাবার খাব। মানুষের থেকে আমরা কিছুতে কম নাকি? মানুষের মতো হাত-পা-মুখ সবাই আছে আমাদের। আবার বাড়তি একটা লেজও আছে! অতএব, আমরা মানুষের মতো খাবার খেতেই পারি!
জঙ্গল থেকে ইচিং বিচিং ছুটল লোকালয়ে। ভরদুপুরে তারা পৌঁছাল এক মফস্বলে। পৌঁছানোমাত্র সাঁই সাঁই করে তারা উঠে গেল মহল্লার ছাদে। খুঁজতে শুরু করল মানুষের খাবার!
ইচিং একবার এই বাড়িতে উঁকি দেয় তো আরেকবার বিচিং উঁকি দেয় ওই বাড়িতে। না, কোথাও কেউ কিচ্ছু খাচ্ছে না। এ সময় কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। ইচিং বিচিং হতাশ। এমন সময় ইচিং বিচিং দেখল একটা ছোট্ট ছেলে পা টিপে টিপে ছাদে উঠে এল। হাতে আচারের বয়াম।
ইচিং বয়ামটা দেখিয়ে বলল, নিশ্চয় ওটা খেলার জিনিস! এক্ষুনি ছেলেটা ছাদে ওটা গড়িয়ে দিয়ে খেলতে শুরু করবে!
বিচিং বলল, না না। ওটা নিশ্চয় দূরে দেখার দুরবিন…এক্ষুনি চোখে ওঠাবে!
কিন্তু ইচিং বিচিং অবাক হয়ে গেল যখন তারা দেখল ছেলেটা বয়ামের মুখটা খুলে ভেতর থেকে কী সব বের করে গপাগপ খেতে শুরু করল। ছেলেটা এত মজা করে খাচ্ছিল যে ইচিং বিচিংয়ের জিভেও পানি চলে এল।
কী করবে তারা যখন ভাবছে, তখন ভেতর থেকে মায়ের কণ্ঠ ভেসে এল—দীপ্র, তুই কি আবার আচার নিয়ে পালিয়েছিস? দীপ্র বলল, না তো! বলেই বয়ামটা রেখে ছুটল নিচে। ইচিং বিচিং ভাবে, এই সুযোগ। এক্ষুনি ওটা খেতে হবে!
যে–ই ভাবা সেই কাজ! ইচিং বিচিং এক লাফে চলে এল বয়ামের সামনে। খুলে ফেলল বয়ামের মুখ। আহ্, ভেতরে কী দারুণ গন্ধ! বিচিং তাড়াতাড়ি বয়ামের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ফেলল। তুলে নিল একমুঠো আচার। নিয়ে যে–ই না বের করতে গেল, তখনই হাতটা আটকে গেল বয়ামের ভেতর। হায় হায়, কী মুশকিলের কথা! ইচিং ধরে টান দেয়, বিচিং ধরে টান দেয়…না না, হাত বেরই হচ্ছে না! উল্টো আচারের বয়াম উল্টে যাওয়ায় ইচিং বিচিংয়ের শরীর ভরে গেল তেলে!
বিচিং বলল, ইচিং, তুই আমাকে বাঁচা…হাতটা বের করে দে!
: কিন্তু কীভাবে? হাত কাটা ছাড়া তো কোনো উপায় দেখছি না!
ইচিংয়ের কথা শুনে বিচিং আরও ভড়কে গেল। তাহলে সে কি বাঁচবে না? বিচিং ভেউ ভেউ করতে কাঁদতে শুরু করল আর তখনই সেখানে দীপ্র এসে হাজির হলো। দুই–দুইটা বানর দেখে দীপ্র প্রথমে ভয়ই পেল। কিন্তু যখন দেখল বানর দুইটা তারই আচার চুরি করে খাচ্ছে, তখন ভীষণ রেগে গেল সে। কিন্তু দীপ্র রাগলে কী হবে, ইচিং বিচিংয়ের অবস্থা তখন খারাপ। বিচিং তার হাতটা দেখিয়ে দীপ্রকে বলল, ছোট্টবন্ধু, তুমি কি বলবে হাতটা আমি কীভাবে বের করব? ঢোকানোর সময় হাতটা সুন্দরভাবে ঢুকলেও এখন আর বেরই হচ্ছে না!
দীপ্র খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, বয়াম থেকে হাতটা বের করা তো খুবই সহজ!
: খুবই সহজ? আমাকে শিখিয়ে দাও প্লিজ…
: শেখাব। কিন্তু তার আগে তোমাদের দুজনকেই কথা দিতে হবে, হাতটা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বয়ামটা তোমরা আমাকে ফেরত দেবে!
: হ্যাঁ হ্যাঁ কথা দিলাম। এখন আমার হাতটা ছাড়াও তাড়াতাড়ি! কী করতে হবে আমাকে বলো বলো?
দীপ্র একটু হাসল। তারপর বলল, কিচ্ছু করতে হবে না তোমাকে। শুধু মুঠি খুলে নাও তুমি!
: কিন্তু তাতে তো আচার বের হবে না?
: তা না করলে তোমার হাতই বের হবে না!
বিচিং পড়ল মহা চিন্তায়। হাত বাঁচাবে না আচার? ইচিং বলল, দীপ্র যা বলছে তা–ই কর…
বিচিং মুঠো খুলে আচার আবার বয়ামে রেখে দেয়। আর তারপরেই হাতটা বয়াম থেকে বের করে নিতে পারে। ইচিং বিচিং দুজনেই তো অবাক! এটা কীভাবে হলো?
দীপ্র বলল, খুবই সোজা। আচার নিয়ে মুঠিটা বন্ধ করায় সেটা বড় হয়ে গিয়েছিল…তাই তো বের হচ্ছিল না বয়াম থেকে!
ইচিং বিচিং একসঙ্গে বলল, বাহ্! কী দারুণ তোমার বুদ্ধি!
দীপ্র বলল, এবার বয়ামটা দাও।
ইচিং বিচিং মন খারাপ করে বয়ামটা ফেরত দিয়ে দিল। মানুষের খাবার তাদের খাওয়া হলো না। ইচিং বিচিং যখন চলে যাচ্ছে, তখন দীপ্র বয়াম থেকে আচার বের করে দিয়ে দিল ওদের হাতে। বলল, খেয়ে দেখো, মায়ের হাতের আচার!
ইচিং বিচিং ঝটকায় আচার মুখে পুড়ে নিল। আহ্! এমন স্বাদের জিনিস তারা আগে কখনো খায়নি।

বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০১৭

চিত্রনাট্যকারের গল্প

সামনে বসে আছেন ডিরেক্টর আর প্রডিউসার। আমি অভাগা লেখক, আমার মাথা নিচু। ডিরেক্টরের জ্বালাময়ী বক্তব্য, ‘এ দেশে সিনেমাই হচ্ছে না! শুধু নাচা আর গানা দিয়ে সিনেমা হয় না, বুঝলেন? সিনেমার জন্য লাগে গল্প! সে জন্যই তো ভাই আপনাকে ডাকা। দেন না আপনি একটা ফাটায়ে দেওয়া গল্প!’ আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘জি, একটা গল্প আছে।’
ডিরেক্টর বললেন, ‘এবার আমরা কিন্তু একটা অদ্ভুত দারুণ কালজয়ী সিনেমা বানাতে চাই, যা দেখে সবাই একেবারে থ হয়ে যাবে, বুঝলেন না?’
প্রডিউসার কেশে উঠলেন। ডিরেক্টর সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সেটা হবে এমন একটা সিনেমা, যেটা ব্যবসা করবে ধুমধাম! সব হল হাউসফুল যাবে!’
আমি বললাম, ‘খুবই ভালো সিদ্ধান্ত।’
প্রডিউসার বললেন, ‘শোনান, আপনের গল্প শোনান তো!’
আমি বললাম, ‘আমার গল্পটা রাতুল নামের এক ১০ বছরের ছেলের। সে তার জন্মপরিচয় জানে না। তার জন্মপরিচয় খোঁজার জার্নিটাই আমার গল্প।’
ডিরেক্টর বললেন, ‘খুবই ভালো গল্প। একসিলেন্ট!’
আমি অভাগা লেখক। এ ধরনের প্রশংসা সরাসরি শুনে অভ্যস্ত নই। প্রশংসা শোনামাত্র আমার পেট গুড়গুড় করে উঠল। দাঁত কেলিয়ে বললাম, ‘জি, অনেক ধন্যবাদ। তাহলে এর ওপর কাজ শুরু করে দিই!’
ডিরেক্টর বললেন, ‘অবশ্যই কাজ শুরু করে দেবেন। এখন এ দেশে এ রকম ভালো গল্পেরই তো অভাব। এটাকে আমি এমন করে বানাব যে দেখবেন, আপনি পর্যন্ত কানে পাম দর পেয়ে যাচ্ছেন! খুব ভালো স্টোরি ভাই! কিন্তু...’
: কিন্তু?
: কিন্তু হিরোইন নাই ফিল্মে! এটা একটা বিগ প্রবলেম!
: আসলে মানে এটা ওই ১০ বছরের ছেলেটার জার্নি তো...
: তা তো ঠিকই। গল্পে আমরা কোনো হাতই দেব না, কসম! কিন্তু একটা হিরোইন ঢুকিয়ে দেন ভাই গল্পে। নারী ছাড়া দুনিয়া চলে না, সিনেমা চলবে কীভাবে?
: তাহলে রাতুলের মায়ের চরিত্রে...
প্রডিউসার হায় হায় করে উঠলেন, ‘বলছেন কী ভাই, হিরোইনকে মা বানাবেন না...আর মাকেও হিরোইন বানাবেন না প্লিজ! আপনি একটা আস্ত হিরোইন রাখেন না সিনেমায়!’
: কিন্তু গল্পে তো ও রকম জায়গা নেই!
: না না, গল্পে আমরা হাত দিচ্ছি না তো! রাতুলের বয়স কত বললেন, ১০ না?
: জি।
: রাতুলের বয়সটা বাড়িয়ে দিন।
: জি?
: হ্যাঁ। রাতুল ২৫ বছরের তরুণ। ফরসা। ব্যাকব্রাশ চুল। জিনস আর টি-শার্ট পরে। হাতে ব্রেসলেট, বুকে লকেট! থাকে একটা বস্তিতে।
: বস্তিতে?
: হ্যাঁ, বস্তিতে। আর সেই বস্তির পাশেই এক শিল্পপতির বাড়ি। আর সেই শিল্পপতির আছে এক মেয়ে। ২২ বছর বয়স। ফরসা; সুন্দরী। গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
প্রডিউসার বলে উঠলেন, ‘আহা, কী দারুণ! কী দারুণ! খুব ভালো।’ আমি মিনমিন করে বললাম, ‘কিন্তু আমার গল্পটা তো...’
: আপনার গল্পটাই তো। ওই গল্পে আমরা একটুও হাত দেব না। বস্তিতে থাকা আপনার এই রাতুলই তো তার জন্মপরিচয় খুঁজছে। আর তাকে সাহায্য করছে নদী!
: নদী কে?
: আরে, ওই যে শিল্পপতির মেয়ে। হিরোইন। নদীর সঙ্গে আপনার রাতুলের প্রথমে একটা ঝগড়া হয়। রাতুল দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়; আর নদী সাঁ করে তার পাশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। রাস্তা থেকে ছিটকে আসা কাদাপানি লাগে রাতুলের গায়ে। রাতুল চিৎকার করে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে নদীর গাড়ি আটকায়। নদী রেগেমেগে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। নদীর ফার্স্ট এন্ট্রি। দ্রিম দ্রিম মিউজিক। রাতুল-নদী মুখোমুখি। রাতুল বলে, ‘এই মেমসাহেব, গাড়িওয়ালা হয়েছেন বলে কি রাস্তার মানুষদের চোখে পড়ে না?’
প্রডিউসার বললেন, ‘বাহ্! কী দারুণ ডায়ালগ! একসিলেন্ট!’
আমি একটা ঢোক গিলে বললাম, ‘কিন্তু আমার গল্পটা তো...’
ডিরেক্টর বললেন, ‘আপনার গল্পটাই তো...এরপরেই রাতুল আর নদী চোখে চোখ...তারপর একটা গান।’
প্রডিউসার বললেন, ‘ইয়েস। বৃষ্টিভেজা গান। হিরোইন সামনে ছুটছে...পেছনে হিরো। লোকেশন কক্সবাজার!’
ডিরেক্টর বললেন, ‘না স্যার, এই সিনেমায় একটু খরচ করেন, স্যার। একটা গান থাইল্যান্ডে, স্যার!’
প্রডিউসার বললেন, ‘ওক্কে, থাইল্যান্ডেই হোক!’
ডিরেক্টর হেসে বললেন, ‘দেখেছেন, আপনার গল্পে স্যার খুব ইমপ্রেসড। সোজা থাইল্যান্ড!’
: কিন্তু...
: আরে, কোনো কিন্তু না! আপনার গল্প তো দাঁড়িয়ে গেছে, ভাই। আপনারই গল্প!
: আসলে আমারটা জন্মপরিচয় খোঁজার গল্প ছিল একটা ছেলের।
: এখানেও তো তাই। আমাদের হিরো তার জন্মপরিচয় খুঁজছে। খুঁজতে খুঁজতে জানতে পারে নদীর বাবাই আসলে তার বাবাকে মেরেছে!
: কার বাবাকে?
: হিরোর বাবাকে।
: কবে?
: অনেক আগে। হিরোর বাবা আসলে ছিল একজন সৎ পুলিশ ইন্সপেক্টর। আর নদীর বাবা ছিল চোরাকারবারি! দুজন মুখোমুখি। সৎ আর অসতের দ্বন্দ্ব। সংঘাত! সাসপেন্স! সিনেমায় নতুন অ্যাঙ্গেল। হিরোইনের বাবা মেরে ফেলে হিরোর বাবাকে!
: কিন্তু এটা তো অন্য গল্প হলো! আর নতুন কিছুও তো না...
: কে বলল, নতুন কিছু না! হিরোইনের বাবা হিরোর বাবাকে মেরে ফেলছে একটা সামান্য নেইলকাটার দিয়ে। সেই নেইলকাটার হিরো তার পকেটে নিয়ে ঘোরে!
প্রডিউসার বললেন, ‘একসিলেন্ট! এটা একেবারে নতুন উইপেন! নেইলকাটার নিয়ে একটা গানও হতে পারে। মদ খেয়ে হিরোইন হাতে নেইলকাটার নিয়ে গান গাচ্ছে! আহা, চোখ ভিজে যায়!’
: কিন্তু...
: আর কিসের কিন্তু? একেবারে আপনারই গল্প! হিরো রিভেঞ্জ নেবে। জন্মপরিচয় বের করবে। জানতে পারবে তার মা আজও বেঁচে আছে। আবারও নতুন অ্যাঙ্গেল সিনেমায়। মা বেঁচে আছে, কিন্তু মায়ের স্মৃতি নাই। একটা গান। পুরোনো একটা গান। এই গান শুনত হিরোর মা। এবার হিরো গেয়ে ওঠে ওই গানটাই। পরেরটা স্যাড ভার্সনে। মা ছুটে আসছে...হিরো ‘মা’ বলে জড়িয়ে ধরছে মাকে! হিরো তার জন্মপরিচয় খুঁজে পাচ্ছে!
প্রডিউসার প্রায় কেঁদে ফেলতে ফেলতে বললেন, ‘আহা, কী সিন! উফ্‌ফ্!’
আমি বললাম, ‘কিন্তু আমার গল্পের শেষটা তো এমন না!’
ডিরেক্টর বললেন, ‘আরে, আপনি যেমন শেষ ভেবেছেন, তেমনই হবে সব। কোনো অসুবিধা নাই। তবে হিরো আর হিরোইনের মিল কিন্তু করাতেই হবে। হ্যাপি এন্ডিং!’
: মানে আমার গল্পটা তো আসলে এ রকম ছিল না...
: কে বলল, এ রকম ছিল না? এ রকমই ছিল। আপনার গল্প আর আমরা জানি না? আপনি যখন বলছেন একজনের জন্মপরিচয় খোঁজার গল্প, তখনই আমরা বুঝে গেছি। খুব ভালো গল্প এটা। আপনাকে কংগ্রাচুলেশন! আপনার অসাধারণ গল্পটা নিয়ে আমরা ফিল্ম করছি! শুধু একটা চেঞ্জ করতে চাই...
: আবার কী?
: হিরোর নামটা। হিরোইনের নাম যেহেতু নদী, হিরোর নামটা তাই সাগর হোক, কী বলেন? এইটুকু চেঞ্জ কিন্তু ভাই করতে দিতেই হবে। আর আমি তো সিনেমার নামও পেয়ে গেছি—ও নদী, ও সাগর! কী বলেন, খুব মিনিংফুল হয়েছে না নামটা? ভাই, আপনার পছন্দ হয়েছে তো? আপনারই তো গল্প, শুধু নামটা আমরা দিলাম। এটুকু তো করতেই পারি, তাই না?
আমি আর কিছু বললাম না। ওদের কন্ট্রাক্ট পেপারে শুধু সাইন করে একটা সিনেমার গল্প লেখায় হাত দিলাম।

মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

একদিন এক ভ্যাটকানো রাস্তায়

অাঁকা: িশখাঅাঁকা: িশখামুসলিম ভাইদের প্রতি সালাম, হিন্দু ভাইদের প্রতি নমস্কার এবং অন্যান্য ধর্মের লোকদের প্রতি আবু মজমাদারের শুভেচ্ছা। আজকে আমি আপনাদের সামনে নিয়া হাজির হইছি আজব এক জিনিস। এই যে আমার কালো ব্যাগ দেখতে পাচ্ছেন ব্রাদার, কী মনে হয়, এর ভিতর কী আছে? কী আছে? জায়গায় দাঁড়ায়া আওয়াজ দেন ভাই, কী মনে হয়, এই ব্যাগের ভিতর আছে কোন সে আজব জিনিস! সাপ নাকি শাপ? ব্যাঙ নাকি ব্যাংক? ভুল করলেন ভাইটি আমার! আকরাব আকরাব! খোল খোল, এই ব্যাগ…খোল! এই যে দেখেন ভাই, ভালো কইরা দেখেন, দেখেন, না, কোনো থলের বিড়াল না এইটা, কোনো রকেট বামও না, দাঁতের মাজনও না এইটা কিন্তু ভাই! কোনো সর্বরোগহারী অব্যর্থ মলমও কিন্তু না! তাইলে কী এইটা? আকরাব! আকরাব!! এইটা হইল ভ্যাট! ভ্যাট!!

এই দাঁড়া…খাড়া এইখানে, কই যাস তুই! এ বড় পিছলা ভাই! খালি হাত থেইকা ফসকায়া যাইতে চায়, আর খালি দৌড়ায় আর বড় বড় লম্ফঝম্ফ দেয়! আমার ওস্তাদ এরে সেই এভারেস্টের গুহার ভিতরে প্রথম আবিষ্কার করছিল! তারপর থেইকা এই ভ্যাট খালি লাফাইতে চায়! ওস্তাদরে বলছিলাম, ওস্তাদ, এই ভ্যাট নিয়া আমরা কী করব? এরে কি অলিম্পিকে পাঠায়ে দিব? এ তো লাফাইতে লাফাইতে বাইড়া যাইতেছে! অলিম্পিকে দীর্ঘ লম্ফে খাড়াইলে নিশ্চয় স্বর্ণপদক পাইব!

ওস্তাদ কী বলছিল, জানেন? ওস্তাদ বলছিল, ওরে নাদান, ওরে আমার পেয়ারের আবু, তুই এখনো এই ভ্যাটরে চিনতে পারস নাই! এরে অলিম্পিকে পাঠানোর দরকার নাই! কী নাই? অলিম্পিকে পাঠানোর দরকার নাই! এরে তুই নিজের কাছেই রাখ। আর বছর বছর সময়মতো তোর কালো ব্যাগ থেইকা বাহির কর! দেখবি, এই ভ্যাট তোর জন্য স্বর্ণপদক না হীরার পদক নিয়া আসবে! হীরার পদক!

তা এই হীরার পদক আনা ভ্যাট দিয়া আপনারা কী করবেন, ভাই? আছে কোনো চিন্তা? এই ভ্যাট কী উপকারে লাগব আপনাদের, ভাবছেন কিছু? ভাবেন নাই। আমি তাইলে কই। বাড়ির গিন্নি-বউ-মা-বোনেরা রান্নায় বেশি তেল দিয়া দিতাছে না? কী, দিতাছে? না দিতাছে না, কন! উত্তর দেন না ক্যান? দিতাছে না? আর সেই বেশি তেল খাইয়া আপনার পেট খারাপ, মন খারাপ, মাথা খারাপ! সারা দিন বস আর পাতিবসদের জি স্যার জি স্যার বলিয়া তেল দেওয়ার পর আর কোনো তেলই আপনার সহ্য হইতেছে না! তেল খাইলেই বদহজম। গ্যাস্ট্রিক আর বদঢেকুর! আর এই সব থেইকা মুক্তির উপায় হইল এই ভ্যাট!

এই ভ্যাট রান্নার ওই তেলের সঙ্গে আমি যুক্ত কইরা দিতাছি! আর দেখেন, তখনই আপনি বাড়িতে বলতে পারবেন তেলের দাম বাইড়া গেছে, তেল খাওয়া নিষেধ! যে কাজ আপনি নিজে এত দিন বইলা করাইতে পারেন নাই, দাম বাইড়া গেছে শুনলেই বাড়িতে তেল খাওয়া দেখবেন অটোমেটিক কইমা গেছে! এখন দরকারি জিনিসের দাম অনেক বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু এই ভ্যাট শুধু কোম্পানির প্রচারের জন্য এইবার মাত্র ১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট!
আপনারা যদি আরও মনে করেন এই ভ্যাট আপনাদের কী কাজে লাগবে, তাইলে ব্রাদার, একটু খেয়াল করেন। আপনার প্রতিদিনের জিনিসপত্রের সঙ্গে এই ভ্যাট লাগায়ে দিলেই আপনার প্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে! তখন কী হবে? কী ভাই, উত্তর দেন না কেন? কী হবে তখন? এই দেশে যখন আপনি আর হাতের নাগালে জিনিস পাবেন না, তখন তা কিনতে চলে যাবেন দেশের বাইরে। একই জিনিস দেশের বাইরে থেকে আপনারা কিনে আনবেন অনেক সস্তায়। সপ্তাহে সপ্তাহে তখন আপনাদের বিদেশ ভ্রমণ নিশ্চিত! কী, আপনারা বিদেশ ভ্রমণ করতে চান না, ভাই? চান কি চান না, বলেন? যাঁরা বিদেশে যাইতে চান, জায়গায় খাড়ায়া আওয়াজ দেন খালি। কোম্পানির প্রচারের জন্য এই ভ্যাট এইবার শুধু ১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…
এই যে বছরে এতগুলা উৎসব আর প্রতিটা উৎসবে নতুন নতুন জামাকাপড় কিনার হিড়িক। উৎসব আসা মানেই আপনার পকেট থেইকা টাকা পাখির মতো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ কইরা উইড়া যাইতেছে। এইটা যদি বন্ধ করতে চান, তাইলে এই ভ্যাট হইল আপনার জীবনের শেষ চিকিৎসা মানে দ্য লাস্ট ট্রিটমেন্ট! এই ভ্যাট লাগানো মাত্রই আপনাদের পোশাকের দাম এক লাফে লম্বা হইয়া যাবে। আর দাম লম্বা হইলেই আপনার পরিবারের মানুষদের বুঝায়ে বলার সুযোগ পাইবেন আপনি। বলবেন, গত বৈশাখের পাঞ্জাবি এই বৈশাখে প্রয়োজনে শার্ট বানায়ে পরো! আপনাকে আর নতুন জিনিস কিনতেই হইব না, ব্রাদার! আকরাব! আকরাব! এক্সট্রা খরচ থেইকা যে এইবার বাঁচতে চায়, সে জায়গায় খাড়ায়া আওয়াজ দেন খালি। কোম্পানির প্রচারের জন্য এই ভ্যাট এইবার শুধু ১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…
ভ্যাট! ভ্যাট!! ভ্যাট!!! আছেন কোনো সহৃদয় ব্যক্তি, আছেন? থাকলে জায়গায় খাড়ায়া আওয়াজ দেন! কোম্পানির প্রচারের জন্য এইবার শুধু ১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট!!!

বাঘমামা

বনে আর কোনোভাবেই মন টিকছে না বাঘমামার। কোথাও একটু ঘুরতে গেলে ভালো হতো! শেয়াল এসে বুদ্ধি দিল। বলল, ‘ঘুরতে যখন যাবেন তখন রাজধানীতেই যান...মানে ঢাকায়!’
: ঢাকা? কিন্তু আমি তো কিছুই চিনি না।
: কোনো চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে ট্রেনে উঠিয়ে দেব। পু-ঝিকঝিক করতে করতে আপনি পৌঁছে যাবেন ঢাকায়। ঘুরবেন ফিরবেন খাবেন দাবেন...আরামই আরাম।
সে রাতেই বাঘমামা উঠে গেল ট্রেনে। বসল একটা কামরায়। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাঘমামা বলল, ‘শোনো, বনটা কিন্তু দেখে রেখো। আমি খুব দ্রুতই চলে আসব।’
শেয়াল বলল, ‘কোনো চিন্তা করবেন না। আমি সব দেখে রাখব।’
পোওওও আওয়াজ তুলে ট্রেনটা চলে গেল। আর শেয়ালটা হাসতে হাসতে পৌঁছাল বনে। চিৎকার করে ডেকে বনের সবাইকে বলল, ‘বনের পশুপাখি গাছপালা সবাই মন দিয়ে শোনো...আজ থেকে আমিই বনের রাজা। আমি যা বলব আজ থেকে তা-ই হবে।’
শেয়াল বনের রাজা হবে শুনে পশুপাখিদের খুব মন খারাপ হলো। বাঘমামার মতো কি আর কেউ বনটাকে আগলে রাখতে পারবে?
ওদিকে বাঘমামা নামল ট্রেন থেকে। গভীর রাত। রাস্তায় শুধু হলুদ হলুদ আলো। কিন্তু বাঘমামার পেটে খুবই খিদে। ছটফটিয়ে বাঘমামা ঢুকল এক হোটেলে। বলল, ‘হালুম, খাবার আছে কোনো?’
হোটেলের লোকজন বাঘমামাকে দেখে যে যার মতো দৌড়ে পালাল। শুধু সবচেয়ে ছোট্ট যে সে বলল, ‘বসেন আরাম করে। এখন শুধু কাচ্চি আছে, খাবেন?’
বাঘমামা বলল, ‘কাচ্চি-মাচ্চি যা পাচ্ছি তা-ই খাব!’
ছোট্ট ছেলেটা এক প্লেট কাচ্চি বিরিয়ানি দিল বাঘমামাকে। বাঘমামা হাপুস-হুপুস করে খেলো। তেল একটু বেশি কিন্তু খুব আরাম পেল খেয়ে। তারপর হেলতে-দুলতে গিয়ে শুয়ে পড়ল রাস্তার মাঝখানে। একটা হাই তুলে, থাবা দিয়ে নাকটা একবার চুলকে ঘুমিয়ে পড়ল সেখানেই।
সকালে বাঘমামার ঘুম ভাঙল চিৎকারে। চোখ মেলেই দেখল অনেক মানুষ তাকে ঘিরে রেখেছে দূর থেকে। তারা বলছে, ‘এটা নিশ্চয় চিড়িয়াখানার বাঘ, পালিয়ে এসেছে!’
একজন বলল, ‘কিন্তু একে ধরব কীভাবে?’
আরেকজন বলল, ‘দূর থেকে ইনজেকশন মেরে বাঘটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। তারপরেই ঢুকিয়ে দিতে হবে চিড়িয়াখানার খাঁচায়!’
এসব শুনে তো বাঘমামার মাথা ঘোরার দশা। হালুম বলে লেজ গুটিয়ে সে দিল এক দৌড়। মানুষগুলো ছুটতে শুরু করল তার পেছনে। বাঘমামা আরও জোরে দৌড়াতে শুরু করল—দৌড় দৌড় দৌড়!
দৌড়াতে দৌড়াতে বাঘমামা ঢুকে পড়ল গুনগুনদের বাসাতে। গুনগুন তখন ড্রয়িংরুমে বসে পড়ছিল। বাঘমামা ঢুকেই বলল, ‘আমাকে বাঁচাও। ওরা আমাকে চিড়িয়াখানায় বন্দী করে দেবে।’
গুনগুন একটু ভেবে বলল, ‘শোনো আমি যা বলব তা-ই করবে, ঠিক আছে?’
বাঘমামা মাথা নাড়িয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘ঠিক আছে।’
একটু পরেই লোকগুলো এল ছুটতে ছুটতে। গুনগুনের পাশেই বাঘমামাকে দেখে বলল, ‘অ্যাই মেয়ে, এই বাঘটাকে দাও। আমরা চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব!’
গুনগুন তখন ফোকলা দাঁতে হেসেই খুন। বলল, ‘কে বাঘ? ওটা তো আমার বিল্লি!’
: কী বলো, ওইটা বাঘ। দেখছ না ওটার গায়ে ডোরাকাটা!
: ওই ডোরা তো আমিই কেটেছি...কেটে বাঘ সাজিয়েছি।
: না না ওটা বাঘ। হালুম-হুলুম বাঘ।
: না না ও তো বিল্লি। ওর নাম মিনি। মিনি ডাকো তো একবার...
বাঘমামা তখন ডেকে উঠল—মিউ মিউ!
লোকগুলো তো ভীষণ অবাক। সত্যিই তো, এমনভাবে তো বেড়ালই ডাকে। বাঘ হলে তো ডাকত হালুম বলে। লোকগুলো চলে গেল। আর তখনই বাঘমামা আর গুনগুনের বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
আর বন্ধু হলে তো বন্ধুর উপকার করতেই হয়। গুনগুন তাই তার বাবাকে বলে বাঘমামাকে বনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। ট্রেনে চেপে পরের দিনই বাঘমামা পৌঁছাল বনে। আর বনে গিয়ে দেখল এর মধ্যেই শেয়াল গাছ কাটাচ্ছে, ডাল ভাঙছে, সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। বাঘমামা রেগে গিয়ে দিল ভীষণ ধমক। যারা গাছের মগডালে বসে ডাল কাটছিল তারা টুপটাপ খসে পড়ল। শেয়াল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আপনি এখানে কীভাবে এলেন? আপনাকে ওরা চিড়িয়াখানায় বন্দী করেনি?’
বাঘমামা বলল, ‘না। বুদ্ধিমান ছোট্ট বন্ধু আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তোমাকে এবার কে বাঁচাবে?’
বাঘমামা এক থাবায় উড়িয়ে দিল শেয়ালকে। বনের বাইরে দূরে কোথায় যে শেয়ালটা পড়ল কেউ জানে না। বনের সবাই একসঙ্গে তালি দিয়ে উঠল। বাঘমামা ফিরে এসেছে, বনটা এবার বাঁচবে!
গোলপাতায় লেখা বাঘমামার চিঠি আজকে গুনগুন পেয়েছে। চিঠিতে মামা সবাইকে তাদের দারুণ সুন্দর বনটা ঘুরতে যেতে বলেছে। গুনগুন ঠিক করেছে পরের ছুটিতেই তারা বন ঘুরতে যাবে। আর সঙ্গে নিয়ে যাবে বাঘমামার ঢাকার প্রিয় খাবার কাচ্চি বিরিয়ানি।

বাবা হওয়া সহজ নয়

 পৃথিবীতে হাঁটাবাবা, ছালাবাবা, কানাবাবা, ছানাবাবা, পাগলাবাবার মতো হাজারো বাবা থাকার পরও আমি সেই ছেলেবেলা থেকে শুধু সাধারণ এক বাবা হতে চেয়েছিলাম। এর কারণও আছে। খুব অল্প বয়সেই নিজের বাবাকে দেখে বুঝেছিলাম, বাবা হওয়া মানেই বিরাট স্বাধীনতা। একে তো বাড়ির সবাইকে ধমকেধামকে দৌড়ের ওপর রাখা যায়, তার ওপর খেয়ালখুশিমতো বাড়ি থেকে বের হওয়া থেকে শুরু করে ইচ্ছামতো বাড়িও ফেরা যায়। কারও কিচ্ছু বলার নেই।

তাই ছেলেবেলায় কেউ যখন জানতে চাইত, ‘বলো তো হীরক, বড় হয়ে তুমি কী হবে?’ আমি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিজ্ঞানী প্রভৃতি ছকবাঁধা জবাবের ধার দিয়েও যেতাম না। সপাট বলতাম, ‘বড় হয়ে আমি বাবা হব।’

আমার উত্তরে কেউ হাসত, কেউ ধমক দিত। কিন্তু আমি লক্ষ্যচ্যুত হইনি। বাবা হওয়ার দুর্মর বাসনা নিয়েই আমি বেড়ে উঠেছি। তার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ছিল ক্লাস নাইনে। এইটের সোমাকে যেদিন প্রথম (এবং শেষ) এবং দীর্ঘ প্রেমপত্রটি লিখলাম সেদিনই, সেই চিঠির শেষ লাইনে লিখেছিলাম, ‘সত্যি বলছি সোমা, আমি আর অন্য কিছু নয়, শুধুই বাবা হতে চাই!’

সোমা আমার চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছিল তার বড় বোনের হাতে। বড় বোন মারফত চিঠিটা যেই না সেজ ভাইয়ের হাতে পৌঁছাল, অমনি আমার পিঠে ফুটে উঠল লাল-নীল-বেগুনি দাগ। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কলেজজীবনে রুনাকে এই কথা জানালাম একটু অন্যভাবে। আশ্রয় নিলাম কবিতার। লিখলাম, ‘রুনাঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো না কো তুমি, ও তো বড় হাবা/ আমাকে সুযোগ দাও, আমি হবো ভালো এক বাবা!’

রুনার এক বড় ভাই আছে, সেই ভাই যে এসআই তা আমার জানা ছিল না। যখন জানলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। একটা পুরা রাত মা-মশাদের সঙ্গে কাটানোর পর সকালে যখন আমার বাবা আমাকে নিয়ে আসছেন, তখন ভেতরের বাবা হওয়ার আশাটা একেবারেই ম্রিয়মাণ।

কিন্তু বাবাই আবার আমার বাবা হওয়ার খেয়ালটা চাগিয়ে দিলেন। এক অবসরে তিনি আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘নে বাবা, এবার বাবা হবি না কাকা হবি তোর ব্যাপার!’

বাবা ছেড়ে দিলে কী হবে, আত্মীয়স্বজন তো ছাড়ে না। দেখা হলেই বলে, ‘কী, কদ্দুর? বাবা কবে হবি?’
আরে, কী মুশকিল! আমি তো ছারপোকা নই যে কিছুক্ষণের মধ্যেই বংশবিস্তার করে ফেলব! সবকিছুর একটা সময় আছে, একটা ক্ষণ আছে। আত্মীয়রা তাকিয়ে থাকে কৌতূহলে। আমি ইনিয়ে-বিনিয়ে বলি, ‘এই তো!’
ওরা বলে, ‘আরে না না, দেরি করিস না একদম। বাবা হওয়া তো সহজ কিছু না। অনেক ঝক্কি। সন্তানকে বড় করতে হবে, তার লালনপালনের দিকে লক্ষ রাখতে হবে, ভালো স্কুলে পড়াতে হবে, সব পরীক্ষায় যেন গোল্ডেন পায়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে!’
: গোল্ডেন এ প্লাস?
: হ্যাঁ, গোল্ডেন এ প্লাস না পেলে সন্তানকে পড়িয়ে আর লাভ কী? এখন তো সবাই গোল্ডেন এ প্লাস পায়, আর তোর ছেলে পাবে না?
: ছেলে? মেয়েও তো হতে পারে।
: হতে পারে, অসুবিধা কী! ছেলে হোক মেয়ে হোক গোল্ডেন এ প্লাস কিন্তু লাগবেই লাগবে!
: আচ্ছা।
: শুধু আচ্ছা না, ভালোমতো রেডি হ। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে হবে।
: ইংলিশ মিডিয়ামে?
: না তো কী, বাংলা মিডিয়ামে পড়াবি ছেলেকে?
: মেয়েও তো হতে পারে।
: হোক না, আপত্তি কিসের? কিন্তু ছেলে হোক মেয়ে হোক ইংলিশ মিডিয়াম কিন্তু লাগবেই লাগবে!
: আচ্ছা আচ্ছা।
: আচ্ছা আচ্ছা কী? তোর ইংরেজি খুবই পুওর। এখন থেকেই ইংরেজি পড়া শুরু কর, না হলে তোর বাচ্চার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে পারবি না। বাচ্চা তোকে মূর্খ বলবে। সন্তান তোকে মূর্খ বললে শুনতে ভালো লাগবে?
: না।
আমি পরের দিনই ২৭দিনেইংরেজিশিক্ষাবইটা কিনে নিয়ে এলাম। মনে মনে বললাম, ‘বাবা হওয়া দেখছি সহজ বিষয় না!’
আর ওদিকে ২৭ দিনে ইংরেজি শেখার আগেই সুখবরটা চলে এল। ডাক্তার আমার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনি তো বাবা হতে চলেছেন!’
ডাক্তারের ফিসফিসানি দেখে আমি ভড়কে গেলাম। আমি বাবা হতে চলেছি নাকি আমার ফাঁসি হতে চলেছে? আমি বললাম, ‘জি, এটা তো খুশির খবর।’
ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘বাবা হতে যাচ্ছেন, এটার মানে জানেন তো? এখন থেকে অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হবে আপনাকে। এটা ফাঁসির চেয়ে কম কী?’
: আচ্ছা।
: আর সব সময় স্ত্রীর টেক কেয়ার করবেন।
: জি, নিশ্চয়ই করব।
: তার খাওয়ার প্রতি নজর রাখবেন!
: জি জি, রাখব।
: আর তার সঙ্গে একদম ঝগড়া করবেন না, বুঝতে পেরেছেন?

সবই ঠিক ছিল, কিন্তু বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া না করে থাকাটা হয়ে পড়ল খুব মুশকিলের। সারা সপ্তাহ অফিস করে সপ্তাহান্তে বউয়ের সঙ্গে একটু ঝগড়াই তো ছিল আমার একমাত্র বিনোদন। এই বিনোদনে ব্যাপক টান পড়ল। বউ আর আমার কথোপকথন হতে থাকল এই রকম-
বউ: তুমি একটা দায়িত্ব–কর্তব্যহীন উজবুক!
আমি: ঠিকই তো। আমারও নিজেকে এমনই মনে হয়।
বউ: তোমার চেয়ে গাধারাও জ্ঞানী।
আমি: আলবত। আমার তুলনায় গাধা হলো জ্ঞানতাপস।
কিছুদিনের মধ্যে বউও প্রতিবাদহীন গোবেচারা আমাকে আর মেনে নিতে পারল না। কেমন ভেজিটেবল মার্কা হয়ে গেল আমাদের কথাবার্তা।
: খেয়েছ?
: হুম।
: ওষুধ খেয়েছ?
: হুম।
: আচ্ছা, ঘুমিয়ে পড়ো।
: আচ্ছা।
এই নিরুত্তেজনার জীবনে সাময়িক উত্তেজনা হিসেবে এল অনাগত সন্তানের নামকরণ।সোনামণিদের১০১টিসুন্দরনাম বইটা নিয়ে দেখা করতে এল কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। বউকে দেখলাম সে অনলাইনে নাম খুঁজে চলেছে। আমি বললাম, ছেলে হলে তীব্র, মেয়ে হলে তুলতুল। বউ সপাটে ‘না’ করে দিল। এই নিয়ে অনেক দিন পর একটু ঝগড়াও হলো। মনে একটু প্রশান্তি নিয়ে সে রাতে ঘুমাতে গেলাম।
নির্দিষ্ট দিনে আমি বাবা হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকলাম ওটির সামনে। নাটক-সিনেমায় যেমন দেখেছি তেমন করে পায়চারি করতে লাগলাম। হাত কামড়ানো, পা কামড়ানো অবস্থা। তখন এক বন্ধু এসে বলল, ‘ভয় পাস না, নবজাতকদের স্মৃতি থাকে না। তোকে দেখে নিতান্তই যে উদ্বাস্তুর মতো লাগছে, তা তোর সন্তান কোনোভাবেই মনে রাখতে পারবে না!’
তারপরও হাত দিয়ে মাথার চুলটা যেই ঠিক করতে যাব অমনি দরজা খুলে গেল। নার্স আমার কোলে সদ্যোজাত মেয়েটিকে দিতেই আমি মনে মনে বলতে গেলাম, ‘আমি পাইলাম। আমি ইহাকে পাইলাম।’ কিন্তু তার অাগেই মেয়ে কাঁদতে শুরু করল। আত্মীয়স্বজন ছুটে এল। ‘সর সর, ছাড় ছাড়! কেমন বাবা হয়েছিস? মেয়েটাকে কোলেও নিতে পারছিস না?’
আমি দেখলাম আমার মেয়ে অন্যদের কোলে দিব্যি খুশ হালে আছে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। এরপর যখনই মেয়েকে কোলে নিতে চাই, মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখমুখ কুঁচকে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। আত্মীয়স্বজনের ধমকের মুখে পড়ি। তারা বলে, ‘কেমন বাবা তুই? মেয়েটাকে কাঁদাচ্ছিস কেন? তুই তো দেখছি এখনো বাবাই হতে পারলি না!’
সত্যি, মেয়ে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো বোধ হয় বাবা হতে পারিনি। কিন্তু আমিও লেগে আছি, হাল ছাড়িনি। বাবার কসম, বাবা আমি হবই!