সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪

মেঘমল্লার : যত্ন করে বানানো না-গল্পের সিনেমা অথবা আমাদের শীত ও উষ্ণতার গল্প





















আমাদের এই কথা বলার পেছনে যা কাজ করেছিল তা হলো আসলে সিনেমাটা নিয়ে তারা খুব কথা বলছিলেন। তারা, মানে যাদের কথার গুরুত্ব আছে। ১২ ডিসেম্বরের আগেই সিনেমাটার একটা স্পেশাল শো রাখা হয় ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সে। সেখানে সুধীজনেরা সিনেমাটা দেখেন এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তাঁদের মধ্যে থেকে এরকম একটা ভাষ্যও উঠে আসছিল যে বাংলাদেশের সিনেমা বদল হওয়ার শুরুটা হয়েছে এই মেঘমল্লার ধরে।

আমরা যারা হতাশাবাদী, এবং সিনেমাপাগল, কিন্তু সিনেমাবোদ্ধা নই, আমরা তখন খুব আশাবাদী হয়ে উঠি। আমরা তক্কে তক্কে থাকি কখন সিনেমাটা দেখতে যাবো। আমরা বলতে থাকি যে আমরা যাবো, কিন্তু আমাদের যাওয়া হয় না। আমাদের অপেক্ষা দীর্ঘ হয়।এছাড়াও আরো ব্যাপার ছিল। একটা ব্যাপার যে সিনেমাটার গল্প আবার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রখ্যাত গল্প রেইনকোট থেকে নেয়া হয়েছে। আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি ফলে। আবার ভাবি যে ওই গল্পটার কথা, মানে রেইনকোটের কথা, আমাদের ভুলে যেতে হবে। কারণ আমরা জানি, জানি মানে লোকশ্রুতিতে এই জানা যে, সিনেমার ভাষা আর গল্পের ভাষা বা উপন্যাসের ভাষা আলাদা-- ফলে দুইটার মধ্যে মিলিয়ে ফেললে চলবে না। এই মিলিয়ে ফেলাটা গর্হিত কাজ। ফলে আমাদের কেউ কেউ মূল গল্পটা, ইলিয়াসের গল্পটা, ভুলে যেতে চাই। আর যারা গল্পটি পড়ে নি তাদের আমরা গল্পটা আর সরবরাহ করি না। বলি এখন সময় সিনেমার, গল্পের না।

এখন সময় সিনেমার, গল্পের না। এরকম বলে আমরা বেশ চমকাই, ভাবি তাই কি যে এখন সময় সিনেমারই-- গল্পের সময় কি তাহলে ফুরিয়ে গেল? কিন্তু আমরা এসব বেশি ভাবতে পারি না। কারণ ভাবনার যে অংশ অতিক্রম করলে মানুষ মহৎ হয়ে ওঠে সে অংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে আমরা এখনো শিখি নি। তেমন কলা আমাদের জানা নাই। কিন্তু মেঘমল্লার দেখার জন্য আমরা এক ধরনের প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে যেতে থাকি। এই প্রস্তুতিটা আমাদের সুখী করে তোলে। আমরা প্রতিদিনই বলি আজ যাবো আজ যাবো আর দিনশেষে বলি কাল যাবো এভাবে আর আমাদের যাওয়া হয় না। আমাদের গ্লানি বাড়ে। আমরা চাই বাংলাদেশের বাংলা সিনেমাগুলো আমরা দেখবো... এটা এক ধরনের কমিটমেন্ট এবং আশা যে আমাদের ছবিগুলো খুব ভালো হবে দারুণ হবে... তবে আমরা জানি না আসলে দারুণ সিনেমার সূত্র কী? আমরা সূত্র তো জানি না। এই মূর্খতার জন্য আমাদের কাছে অদ্ভুতভাবে কিছু কিছু বাজারি সিনেমাও ভালো লাগে। আবার পৃথিবী কাঁপানো সিনেমাগুলোরও কিছু কিছু খারাপ লাগে। অবশ্য আমরা এসব বলতে পারি না... যদি বোদ্ধারা আমাদের জ্ঞানের খামতিটা ধরে ফেলে! আমরা তাই চুপ থাকি!

আমরা চুপ থাকি কিন্তু আমাদের ভেতর ছটফট করতে থাকে এবং এক সকালেই আমরা ঠিক করি আজই আমরা মেঘমল্লার দেখতে যাবো। আজ না গেলে আর কখনো নয়। মেঘমল্লার দেখতে না গিয়ে আমরা সিনেমাটার ওপর এখন পর্যন্ত যে অবিচার করেছি তার ঋণ শোধ করতে আমরা আরো কয়েকজনকে ডাকি। মেঘমল্লার দেখতে যাবার আমন্ত্রণ জানাই। কেউ কেউ অবশ্য জোটে, তবে অনেকেই পিছলে যায়। দুয়েকজন জোটে বলা যায়, তবে আমাদের দলটা ভালোই হয়। অবশ্য সবাই কমবুদ্ধির দর্শক। কিন্তু আমরা তাতে সন্তুষ্ট হই।

আমরা জেনেছিলাম মেঘমল্লার ঢাকার চারটা সিনেমাহলে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে বলাকা একটা। বলাকা আমাদের প্রিয়। বলাকায় টিকেটের দাম তুলনায় কম। এই তুলনাটা আমরা সাধারণত স্টার সিনেপ্লেক্সের সাথে করি। আমরা নিজেদের মধ্যে বলি যে স্টারে দেখার চেয়ে মেঘমল্লার বলাকাতেই দেখা ভালো। এই ভালোটা আসলে অর্থনৈতিক। আর সাথে কিছুটা ইংরেজি থ্রিডি সিনেমাপ্রীতি। এই থ্রিডি সিনেমাগুলো আড়াই শ' তিন শ' সাড়ে তিন শ'-তে স্টারে দেখা যায়, এরকম মনে হয় আমাদের কাছে। মেঘমল্লার তো আর থ্রিডি কিছু না। ফলে তাকে আমরা বলাকাতেই কতল করতে চাই। যেমন কিছু দিন আগে পিঁপড়াবিদ্যাকে করেছিলাম। ফলে আমরা বিভিন্নভাবে বলাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। আমরা নিজেদের ভেতর খুব আগ্রহ বোধ করতে থাকি। সিনেমাটা জাহিদুর রহিম অঞ্জন বানালেও... বানালেও এ জন্যই যে এটি তাঁর প্রথম সিনেমা, সিনেমা নিয়ে এর আগে শুধু শিক্ষকতা করেছেন, শর্টফিল্ম বা ডকুমেন্টারি কিছু বানিয়েছে কিনা আমরা জানি না, আমরা আগেই বলেছি আমরা বেশ মূর্খ দর্শক আছি! তবে মেঘমল্লারের ট্রেলার দেখে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। সঙ্গে শহীদুজ্জামান সেলিম আছেন, তাঁকে আমাদের টিভি-নাটকের দশক থেকেই ভালো লাগে। এবং আমাদের মতো মূর্খদের কাছেও মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের টিভি নাটক অভিনেতাদের যে-কজন নিজের অভিনয়ক্ষমতার সূচককে উত্তরোত্তর ওপরের দিকে নিয়ে গেছেন তার মধ্যে সেলিম একেবারে প্রথম সারির; কখনো কখনো, এমনকি, একমাত্র মনে হয়। কিন্তু মূর্খ হওয়ার কারণে আমরা এত বড় দাবী করতে পারি না। আমরা এরকম দাবী নিজেদের চায়ের আড্ডাতেও ধীরে বলি, যেন অন্য আড্ডারা এসব শুনে না নেয়। শহীদুজ্জামান সেলিম ছাড়াও মেঘমল্লারে অপর্ণা আছেন, তিনি পরিচিত মুখ। আর আছে একটা ছোট মেয়ে। যার কাজ আমরা কখনোই দেখি নি, কিন্তু পরিচালক অঞ্জনের কোনো এক সাক্ষাৎকারে শুনেছিলাম সেই পিচ্চি নাকি অপূর্ব অভিনয় করেছে। ফলে আমাদের খুব লোভ হয়। আমরা, কত দিন, অপূর্ব কিছু দেখি না!

আমরা ঝটফট বলাকার সামনে নামি এবং মেঘমল্লারের পোস্টার দেখার জন্য এদিক ওদিক তাকাই। নাই। পোস্টার নাই। আমরা আশ্চর্য হই বটে তবে আমরা নিজেদের মধ্যে সেই বিস্ময় প্রকাশ করি না। আমরা ভেতরে যাই, টিকেট কাউন্টারে দাঁড়াই। আমরা ছয়টার শো দেখতে চাই। এবং টিকেট কাউন্টার থেকে উত্তর আসে মেঘমল্লার তো চলতাছে না। নাইমা গেছে... 

নাইমা গেছে? মানে কী? আমরা দেখার আগেই সিনেমাটা নেমে যায় কী করে! আমরা এরকম ভাবি। আমরা বিচলিত হই। সংক্ষুব্ধ হই। আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। আমরা জায়গা পেলে পায়চারি করতাম কিন্তু আমরা জায়গা পাই না। তখন কেউ একজন ইন্টারনেট সার্চ করে আর আমাদের জন্য সুসমাচার নিয়ে আসে। তাকে আমাদের ত্রাতা মনে হয়। ত্রাতা বলে, এখনো সময় আছে, সাড়ে সাতটায় শো আছে... স্টার সিনেপ্লেক্সে সাড়ে সাতটায় শো আছে... মেঘমল্লারের শো আছে...

আমরা বেশিক্ষণ ভাবি না। ত্রাতার আহ্বান আমরা সাধারণত কখনোই উপেক্ষা করতে পারি না। এটা আমাদের রক্তের ভেতরেই আছে। আমরা তাই আবার রিকশায় উঠি। স্টার সিনেপ্লেক্সের দিকে আমাদের রিকশা চলতে থাকে। কিন্তু বেশিক্ষণ চলতে পারে না। আমরা বারবার জ্যামে আটকে আটকে যাই। ঘড়িতে ছয়টা এবং রাস্তা পনের মিনিটের হলেও আমরা ভাবতে থাকি যে আমরা শো পাবো কিনা। ঢাকার জ্যাম আমাদের এরকম ভাবায়। আমরা বিচলিত হবো কিনা বুঝতে পারি না। আমরা জ্যামের ভেতর উদ্বিগ্ন হয়ে বসে থাকি। কিন্তু আমাদের রিকশাঅলাগুলো ঢাকার তস্যগলি চেনেন। তাঁরা আমাদের এদিক ওদিক দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বসুন্ধরা সিটির সামনে, অপজিট রাস্তায়, নামিয়ে দেয়। নেমে আমরা মোবাইলে সময় দেখি। দেখি যে আরো বিস্তর সময় আছে। আমরা তখন ভাবি এত সময় নিয়ে আমরা কী করবো?

আমরা ছয়টা টিকেট কাটি। এবং অপেক্ষা করি। অপেক্ষা লম্বা হয়। সাড়ে সাতটায় শো কিন্তু সাতটাও বাজতে চায় না। আমরা খুচরো কাজ করি, টিভি নিয়ে কথা বলি, ঘুরে বেড়াই অযথা তারপর দেখি সাতটা বেজে পার হয়েছে। সাতটা সতেরোর দিকে আমরা হলের করিডোরে ঢুকতে পারি। তিন নাম্বার হলে সিনেমাটা দেখানো হবে, ফলে আমরা সেই সিনেমাহলের দরজার কাছে যাই। এবং একটু ধাক্কা খাই। সাধারণত যেমন দর্শক থাকে দরজার বাইরে, ভেতরে ঢোকার জন্য তাদের মধ্যে যেমন উচাটন থাকে, এখানে এই তিন নম্বরের সামনে তার চিত্রটা একেবারেই বিপরীত। কেউ নাই। আমরা হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে লাইন ধার করি, বলি, আরে কোথাও কেউ নেই!

ফলে এই ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় আমরা ছবি তুলি দুয়েকটা। পপকর্ন কিনি। পপকর্ন কিনতে গিয়ে আমাদের কেন যেন মনে হয় মেঘমল্লারের সাথে পপকর্ন ঠিক যায় না। আমরা হাতে পপকর্ন নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন আমরা একে অপরকে বলি যে আমাদের খুব অদ্ভুত দেখাচ্ছে। আমরা পপকর্ন নিয়ে মেঘমল্লারের জন্য অপেক্ষা করছি-- এটা যেন কেমন... পপকর্ন না হয়ে ভুট্টার খই হলে কি মিলতো বেশি? মেঘমল্লারের সাথে? আমরা এরকম ভাবি আবার ভাবি না। আমাদের দাঁড়ানোর জোর থাকে না, আমরা বসে পড়ি। বসলে আবার ভালো লাগে না, তখন আমরা উঠে দাঁড়াই। এরকম চলতে থাকে কিছুক্ষণ। আমরা হতাশ হই যে তেমন দর্শক নেই। এটাতে হতাশ হই। এরকম একটা হতাশা এই শীতের মধ্যে ধরে। তখন আমাদের আরো শীত করতে থাকে। আমাদের কারো কারো পকেটে বাহারি টুপি। তারা সেগুলো বের করে আর বলে, এসিটা বাড়ানো... কান ঢাকি কান ঢাকি! কিন্তু আমাদের কারো কারো মনে হয় বাইরে থেকে না আসলে শীতটা আসছে ভেতর থেকে। রক্ত থেকে কী? দর্শক নেই আর আমাদের শীত বাড়ে। আমরা দর্শকের অপেক্ষা করি, দর্শক আসে না।

সাড়ে সাতটা বেজে গেলে আমরা হলের ভেতর ঢুকি। আমরা ঢুকতে ঢুকতে ভাবি হলে বোধহয় কেউ নেই। বোধহয় আমরা ছয়জনে একাই সিনেমাটা দেখবো। তারপর ভাবি ছয়জন তো আসলে একা হতে পারে না। এ নিয়ে আমরা একটু হাসাহাসি করি। হাসতে গিয়ে আমাদের হাত থেকে দুয়েকটা পপকর্ন পড়ে যায়। আমরা সেদিকে মায়ার সাথে তাকাই। আমাদের আবারো মনে হতে থাকে মেঘমল্লার আর পপকর্ন এক সাথে যেতে পারে না যেতে পারে না। কিন্তু আমরা যাওয়াচ্ছি বলেই মনে হয়। আমরা সিটে বসে যাই। বসার আগে দেখি একটা সিটের সারি জুড়ে সাত-আট জনের দর্শক। এই দর্শক সারি দেখে আমাদের ভালো লাগে। আমাদের মনে হতে থাকে যে আমরা আসলে একা নই। আমরা ছয়জনেও একা ছিলাম না, কিন্তু এই দর্শক সারি দেখে ভাবতে ভালো লাগে যে আমরা আসলে একা না। ফলে আমাদের হতাশা কাটতে থাকে। আমাদের শীত যেন কমে আসে। যারা টুপি পরেছিল, বা হুডি উঠিয়ে নিয়েছিল মাথায় তারা সেগুলো ফেলে দেয়। কে জানি বলে, ভিত্রে তো গরম মেলা... 
আমরা তখন যে দর্শক এসেছে তাদের দিকে তাকাই। তাদেরও গরম লাগছে বলেই মনে হয়। এক তরুণী দর্শক তার কার্টিগেন খুলে ফেলে। অথচ এসি তো চলছে। বিজবিজ আওয়াজও হচ্ছে। আমাদের ভালো লাগে। হতাশা কাটতে থাকে। আমাদের ভালো লাগে। আমরা বুকের জিপার খুলে দিই। বাইরের শীত থেকে ভেতরের উষ্ণতাকে উপভোগ করি। আমাদের ভালো লাগে।

আমরা তখন বেশ তাড়াতাড়ি পপকর্ন খেতে থাকি, কারণ সিনেমা তখনো শুরু হয় নি। পর্দায় বিজ্ঞাপন চলছে। আমাদের মনে হয় মেঘমল্লার শুরুর আগেই আমাদের পপকর্ন খেয়ে শেষ করে দেয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধ ও তার অবরুদ্ধতার ভেতর পপকর্ন খুব খাস্তা আর শস্তা মনে হতে পারে, আমরা এরকম ভেবে ভেবে পপকর্ন চিবাতে থাকি। একটু শব্দ হয় চিবানোয়, তাতে আমাদের অস্বস্তিও হয়। ফলে আমরা পর্দায় চলা বিজ্ঞপনের দিকে মনোযোগ দিই। কিন্তু বিজ্ঞাপনগুলো ভালো লাগে না। আমরা তখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করি। বলাকা থেকে স্টার সিনেপ্লেক্সে আসায় আমাদের মধ্যে একটা কমপ্লেক্সে তৈরি হয়। আমরা কেউ কেউ ভাবি এর থেকে ইংরেজি কোনো সিনেমা দেখাই হয়তো উচিত। কিন্তু আমরা আমাদের লম্বা প্রস্তুতির কথা ভাবি। আমরা ভাবি মেঘমল্লারের জন্য আমরা যে-সময় আর প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে গিয়েছি তাতে মেঘমল্লারই হবে আজকের জন্য প্রথম ও শেষ। এরকম ভাবতে ভাবতে আরো কয়েকজন দর্শক চলে আসেন। তাঁদের দেখে আমাদের খুব ভালো লাগে। শান্তি শান্তি লাগে। ভাবি যে ভালো সিনেমা দেখার লোক তো এখনো কিছু আছে। আগ্রহ আছে। আমাদের শীত প্রায় শেষ হয়ে আসে।

এরকম আরো কিছু লোক যখন এসে যায়, যখন প্রায় সাতটা পঁয়তাল্লিশ আমাদের মোবাইলে, তখন হঠাৎ পর্দায় জাতীয় পতাকা দেখা যায়। আমরা তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যেতে চাই। আর দাঁড়াতে গিয়ে আমাদের অবশিষ্ট পপকর্ন পড়ে যায়। আমরা পপকর্ন তুলি না, পপকর্ন ছড়িয়ে থাকে। আর আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। জাতীয় পতাকা পতপত ওড়ে। জাতীয় সঙ্গীত বাজে। আমাদের খুব মায়া মায়া লাগে।

এরপর সিনেমা শুরু হয়। আমরা বসে পড়ি। পর্দাজুড়ে বাংলাদেশ। গাছের ঝোপ। গাছের ঝোপ কাঁপতে থাকে। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। গাছ কাঁপতেই থাকে। তারপর একটা ট্রাক আর তাতে সদ্য জন্ম দেয়া বাংলাদেশের ছোট পতাকা উড়তে থাকে, এরকম দেখি। বৃষ্টি। রাতের ঘাটে একটা নৌকা এসে থামে। নৌকা থেকে কয়েকজন তরুণ নামে। পূর্ব অভিজ্ঞতা ও ধারণা থেকে বুঝতে পারি এরা মুক্তিযোদ্ধা। যেহেতু আমাদের প্রেক্ষাপট জানা আছে। কিন্তু যাদের জানা নেই তারা কী করে সময় আর স্থান বুঝবে এরকম একটা প্রশ্ন ওঠে আমাদের ভেতর কিন্তু আমরা খুব স্বৈরতায় প্রশ্নটার গলা টিপে ধরি। আমরা অপেক্ষা করি। দেখি একটা বাড়িতে একটা ছেলে খাতায় কিছু একটা আঁকছে আর বিছানায় দাঁড়িয়ে আছে একটা পিচ্চি মেয়ে। তাদের কথাবার্তায় এবং পরে, ঘরের ভেতরে গৃহিণীর উপস্থিতিতে, আমরা কিছু তথ্য জানতে পারি; তাতে আমরা সিনেমার সূত্র ধরার চেষ্টা করি। বুঝতে পারি এ ছেলেটি ওই গৃহিণীর ভাই, পিচ্চির মামা। সে মুক্তিযোদ্ধা। বোনের চাপাচাপিতে মুক্তিযোদ্ধাটি তার পরনের রেইনকোটটি খুলে রেখে গোসলে যায়। রেইনকোটটি সবার অলক্ষ্যে নিতান্ত সাধারণভাবেই ঘরে থেকে যায়। আমরা কেউ সেদিকে খেয়াল করি না আসলে।




বৃষ্টি আর বৃষ্টি। একটা গুমোট আওয়াজ। জানালা আর মশারির বাইরে থেকে দেখা দৃশ্যগুলো পর পর চলতে থাকে। আমরা কিছু জানতে পারি কিছু ধারনা করি। এখানে আমাদের পূর্বধারণার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা আগের অভিজ্ঞতার সাথে বর্তমান দৃশ্যগুলো জড়িয়ে ফেলে এগোতে থাকি। দেখি শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা হলেও বাড়ির কর্তা এসব যুদ্ধে খুব একটা আগ্রহী নন। তিনি কলেজের শিক্ষক। ছাপোষা ধরনের মানুষ। এবং ভীতু। ভীতু কারণ তাদের বাড়িতে কেউ কড়া নাড়লে, এগিয়ে যেতে চেয়েও, তিনি এগিয়ে যান না। তাঁর স্ত্রী যান। দরজা খুলে দেন। এখানে যেমন বাড়ির কর্তার চরিত্রটা বেশ বোঝা যায় তেমনি বোঝা যায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেশজুড়ে যে অবরুদ্ধভাব ছিল সেটা। আমাদের আবার গরম লাগতে শুরু করে। আমাদের কেউ কেউ শীতের পোশাক খুলে ফেলে। কেউ কেউ খুলবে কি খুলবে না এরকম একটা জায়গায় থাকতে থাকতে সিনেমা দেখতে থাকে। আমরা দেখি যে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ওই বাড়ির কর্তা কলেজ যান নিয়মিত। যদিও কয়েকজন শিক্ষক ছাড়া কলেজে আর কেউই আসে না। স্ত্রীর প্রত্যাশায় রেডিওর ব্যাটারি কিনতে গিয়ে বাড়ির কর্তাটা দোকানদারকে যেন জোর করে জানান ব্যাটারিটা কিনছেন আসলে টর্চের জন্য। আমাদের সামনে তখন একটা চরিত্র যেন দাঁড়াতে চায়, মানে দাঁড়ানোর একটা চেষ্টা যেন করে। আমরা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকি। আমাদের গরম লাগে। শীত আর লাগে না।



এদিকে বাড়ির কর্ত্রীর তার ভাইয়ের প্রতি মমতা যেমন আছে তেমনি গ্রামে চলে যাওয়ার ইচ্ছাও আছে। তিনি রেডিও শুনতেও চান। তেমন প্রবলভাবে প্রকাশ না পেলেও মনে হয় দেশ নিয়ে তার এক ধরনের উদ্বেগ আছে। আর পিচ্চি মেয়েটা যেন কিছুটা নিঃসঙ্গ। সে একা একা দেয়ালে ছবি আঁকে। তার যে মামা যুদ্ধে চলে গেছে সেই মামাই কি তাকে সময় দিতো? তার সাথে খেলতো? ছবি আঁকতো? এরকম একটা সূত্র সিনেমার প্রথমে পেলেও পরে আর পাই না। সেই মামাই কি তার খেলার সঙ্গী ছিল? হতে পারে। নাও হতে পারে। এ ধরনের প্রশ্ন ওঠে এবং সমাধান না হয়েই চলতে থাকে। সমাধানের জন্য আমাদের ভেতর তেমন কোনো ইচ্ছা জাগে না বরং আমরা সিনেমাটার প্রবাহের সাথে চলতে থাকি। সিনেমার ছবি আমাদের চোখকে শান্তি দেয়। আমাদের মনে হয় বাংলাদেশের সিনেমায় আমরা এত ভালো চিত্র দেখি নি। সিনেমার শব্দ আমাদের কানে প্রয়োজনীয় অস্বস্তি দিতে থাকে। আমাদের খুব ভালো লাগে। আমরা নিজেদের মধ্যে বলি ভালো ভালো খুব ভালো। আমরা দারুণভাবে আশাবাদী হয়ে উঠি। এবার ভালো কিছু হবে। দারুণ কিছু হবে। আমাদের খুব গরম লাগতে লাগে। আমরা সবাই শীতের পোশাক খুলে ফেলি আর তখন ইন্টারভেল হয়।




আমরা বাইরে এসে আবারো কিছুক্ষণ ছবি তুলি। একটা ক্রিসমাস ট্রিকে কেন্দ্র করে আমাদের মোবাইলের ক্যামেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে তবে আমরা ভাবতে থাকি সিনেমাটা নিয়ে। আমরা বলাবলি করি যে এত ভালো শব্দ আর এত ভালো দৃশ্য... আমরা যেন খুব আরাম পাই, আমরা দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠি। আমরা সময় শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই ভেতরে গিয়ে বসি। সিনেমায় তখন বাড়ির কর্তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আর্মি ক্যাম্পে। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে তার কাছে প্রশ্ন করা হচ্ছে। লোকটি জানান তিনি কিছুই জানেন না। দর্শক হিশেবে আমরা জানি লোকটি সত্য বলছে। ওদিকে তার বাড়িতে তার বউ আর ছোট মেয়েটা একটা শঙ্কা আর অপেক্ষার জীবন কাটায়।

বলে রাখা ভালো বাড়ির কর্তা যখন আর্মির ডাকে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন তখন তার শ্যালকের রেইনকোটটি পরে বের হয়েছিলেন প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে। আর তখন তার মেয়েটি বলেছিল, বাবা তোমাকে দেখতে মামার মতো লাগছে।
কথাটি আমাদের মধ্যে গুঞ্জরিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আসলে হয় না। আমরা আশা করি সেই সূত্র আমরা পাবো আমরা পাবো। আমরা রেইনকোট ও তার ভেতরের মানুষের পরিবর্তনের যে প্রত্রিয়া তার ভেতর দিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। অপেক্ষা দীর্ঘ হয়, অপেক্ষা শেষ হয় না। অপেক্ষা শেষ হয় না। আমাদের আবার শীত লাগতে শুরু করে। হঠাৎ জাঁকিয়ে শীত পড়ে যেন। যেন হিম পড়ছে। আমরা তাড়াতাড়ি শীতের পোশাক পরি। কিন্তু আমাদের শীত লাগতেই থাকে। শীতের কাপড় ফুঁড়ে শীত আমাদের রক্ত বা হাড় বা অন্য কোথাও, হৃদয়েই নাকি, প্রবেশ করে। আমরা পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের খুব শীত করে। আর অবশেষে আমাদের অপেক্ষা যেন শেষ হয়। কিন্তু হয় বলেই মনে হয় আসলে। পর্দায় দেখি কর্তাটি বলে ওঠেন, আমি জানি সব জানি। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সব জানি। কিন্তু আমি বলব না!




আমরা বুঝতে পারি লোকটা মিথ্যা বলছে, আসলে বিদ্রোহ করছে আর তখন তাকে গুলি মারে আর্মিটি। কর্তাটি, শিক্ষকটি, লোকটি মারা যায়। তার পরনে তখনও সেই রেইনকোট।

তারপর আবার সেই ট্রাকে ফিরে আসি সিনেমায়। গৃহিণী আর তার মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন।ছোটগল্প পড়ার মতো আমাদের অতৃপ্তি থেকে যায়। আমরা যেন আরো কিছু চেয়েছিলাম কিন্তু তা দেখা হয় না। মনে হয় সমস্ত সম্ভাবনাই মরে গেল। মরে গেল আসলে কর্তাটি মরে যাওয়ার আগেই। বিরতির পর থেকেই একটু একটু মরে গেল। দারুণ চিত্র আর শব্দ নিয়ে একটা দারুণ সম্ভাবনার গল্প আর গল্প হয়ে উঠল না। আমাদের প্রচণ্ড শীত লাগে। একজন তার ব্যাগের ভেতর থেকে চাদর বের করে পরে। তাকে দেখে আমাদের কষ্ট হয়। দেখি তার ঠোঁটের ওপর বরফের কুচি। তারপর দেখি আমাদের সবার ঠোঁটের ওপর আর চোখের কোণায় বরফের কুচি। আমরা যেন জমে যাচ্ছি। আমরা উত্তাপ খুঁজতে চাই বারবার স্মৃতি ধরে। কিন্তু আমাদের বরফ গলে না।

হল থেকে বের হতে হতে উত্তাপের আশায় আমরা আবার পর্দায় ফিরে যায়। সিনেমায় যেভাবে ফ্ল্যাশব্যাক ফিরে যান পরিচালক সেভাবেই ফিরে যায়। আর ছবিটা মনে মনে আবার দেখি। বারবার দেখি। তখন কিছু ছবি আটকে যায়। কিছু ছবি আটকাতে চেয়েও সরে যায়। এরকম হয়। আমরা শীতাক্রান্ত হতে হতে বারবার উষ্ণতা খুঁজতে থাকি মাত্র শেষ হওয়ার ছবির ছবিতে। আমরা একটা ক্রমছবি পাই। ছবিগুলো ওই বাচ্চা মেয়েটার।




 বাচ্চা মেয়েটাকে দেখি একটা দৃশ্যে বাবা-মার সাথে রাতের খাবার খাচ্ছে। মা খাইয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বাচ্চাটা খেতে চাচ্ছে না। মা অভিযোগ করেন মাছ মাংস অন্ততপক্ষে ডিম না থাকলে বাচ্চাটা কী করে খাবে? কর্তা একটু অসহায় যেন। বাচ্চাটিকে তার মধ্যেই খেতে বলেন এবং নিজেও খেতে থাকেন।

কর্তার ক্যাম্পে চলে যাওয়ার পর একই রকম একটা দৃশ্যে দেখি বাচ্চাটা নিজে নিজে থালায় ভাত মাখছে। কিন্তু খাচ্ছে না। মা সেটা দেখেন এবং জানতে চান সে ভাত খাবে কিনা। বাচ্চাটা জানায় খাবে না। মা তার হাত ধুইয়ে দেন। বাচ্চার না খাওয়ায় তেমন গুরুত্ব দেন না।একইরকম আরেকটা দৃশ্যে দেখি আরো পরে। সিনেমার শেষের দিকে। দেখি বাচ্চাটা একা একা ভাত খাচ্ছে। তার পাশে বাবা তো নেই, এমনকি মা-ও নেই। বাচ্চাটা একা একা যত্ন করেই খাচ্ছে। আমাদের মনে হয় যুদ্ধের সময়টা আসলে এমনই তো নিষ্ঠুর। ধীরে ধীরে সব কিছু এভাবেই, যুদ্ধে আসলে এভাবেই, বদলে যায়। এই ছবিটা আমাদের মাথায় আটকে থাকে। কিন্তু গল্পটা তো এখানে নয়। মনে হয় গল্পটা অন্য কোথাও। কিন্তু গল্পটা যেখানে সেখানে গিয়েও গল্প পুরোটা পাওয়া যায় না এরকম লাগে। শীত লাগতেই থাকে, শীত কাটে না।

মনে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের দৃশ্যগুলো মূল গল্পের সাথে, আসলে মূল গল্প বলে যদি কিছু থাকে, তার সাথে মেশে নি।
মনে হয় শিক্ষকের মৃত্যুর আগে ও পরের যে অংশগুলো উদ্বেলিত হতে পারতো সেগুলো হয় নি।
মনে হয় সিনেমায় যে প্রশস্ত পটভূমির সুযোগ থাকে তা ব্যবহার করা হয় নি।
মনে হয় যেভাবে গল্পটি বলা হয়েছে, বোধহয় বলার চেষ্টা করা হয়েছে শব্দটিই উপযুক্ত, তা একটা প্রায় পূর্ণদৈর্ঘ সিনেমার জন্য যথেষ্ট নয়।
মনে হয় চিত্র আর শব্দে অনেক যত্নবান, বাংলাদেশের ছবির জন্য পথপ্রদর্শক হওয়া সত্বেও, গল্প বলার জায়গায় রয়ে গেছে স্পষ্ট অযত্ন।

আমরা যত্নের কথা আবার ভাবতে থাকি। তখন আমাদের গরম লাগে। সিনেমাজুড়ে পরিচালকের প্রপস আর চিত্রধারণের যত্নের কথা ভেবে আমাদের চুলের গোরাগুলো ঘামতে থাকে। বসুন্ধরা থেকে বেরিয়ে, বাইরে ডিসেম্বরের হিমবাহ থাকলেও, আমাদের গরম লাগতে থাকে। ভাবি যে আহা কী অদ্ভুত যত্নই না করেছেন অঞ্জন। বাড়ির সমস্ত প্রপস, কলেজের সমস্ত প্রপস, বৃষ্টিধোয়া মেঝে, করিডর এত যত্নের এত যত্নের যে আমাদের গরম কাপড় খুলে ফেলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু পরক্ষণেই আমাদের গল্পটির কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে এই গল্প একটা যথেষ্ট লম্বা সিনেমার জন্য নয়। এটুকু দিয়ে একটা বিশ মিনিটের দুর্দান্ত শর্ট-ফিল্ম হতে পারে, সিনেমার জন্য দরকার আরো কিছু। আমরা আবার হতাশ হয়ে পড়ি। আমাদের শরীরে শীত ফিরে আসে। ভাগ্যিস আমাদের সাথে যে শীতের পোশাক আছে সেগুলোর দেহ-লাগোয়া টুপি আছে। আমরা সেই টুপি মাথায় উঠিয়ে নিই। আমরা হুডি উঠিয়ে নিই মাথায়। উঠিয়ে নিয়ে আমরা নিজেদের বাসার দিকে চলে যাই॥


মেঘমল্লার

পরিচালনা: জাহিদুর রহিম অঞ্জন।
অভিনয়: শহীদুজ্জামান সেলিম, অপর্ণা, জয়ন্ত চট্টপাধ্যায় প্রমুখ।

ব্যবহৃত ছবি: গুগল চিত্র


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন