বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪

আকাশ আসবে নেমে

একটা লাল ঘুড়ি উড়ছিল আকাশে।

আসলে উড়ছিল না তো। কেটে কেটে কেটে লোট খেতে খেতে পড়ে যাচ্ছিল। আর পড়ে যেতে যেতে যেতে কেমন আলোর মতো ঝিকমিক করে উঠছিল। না আকাশে তেমন সূর্য ছিলো না, তার পরেও।

ঘুড়িটার একটা গন্তব্য ছিল। অবশ্য গন্তব্য যতদূর ততদূর উড়বার গতি বা নিয়তি কিছুই ছিল না তার। ঘুড়িটার গন্তব্য ছিল, গতি ছিল না।

১.
রাত সাড়ে এগারটা।

আমেদ হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। পাঁচ তলার দক্ষিণের ফ্ল্যাটে সে ভাড়া থাকে। পাঁচতলা পর্যন্ত উঠতে তার কষ্ট হয় না কোনোদিনই, আজ হচ্ছে। আজ হচ্ছে কারণ তাকে ছুটে যেতে হচ্ছে। আর এই ছুটে যাওয়া গুনগুনের জন্য। গুনগুন তার ছয় বছর বয়সী মেয়ে। আমেদ জানে সে অফিস থেকে না পৌঁছানো পর্যন্ত, যত রাতই হোক, গুনগুন খাবে না, ঘুমাবে না।

আমেদ প্রতি দিনই চেষ্টা করে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে, পারে না। প্রতি দিনই কোনো না কোনো কাজে সে আটকা পড়ে। আজ শেষ সময়ে একগাদা কাজ তার ল্যাপটপটায় ঢুকেছে-- কিছু তার শেষ করতে পেরেছে কিছু কাল করতে হবে। কাল ছুটির দিন তবুও করতে হবে। অফিসের কাজ বাসায় করা নিয়ে রোদেলার খুব কড়া বারণ ছিল। এখন রোদেলা নেই, বারণ করার মানুষটিও নেই-- কিন্তু আমেদের অপরাধবোধটা থেকে গেছে। যেন দেয়ালের ছবিটা থেকে রোদেলা ঠোঁট শক্ত করে বলছে, কী ব্যাপার, অফিসের কাজ বাসায় এনেছো যে? মেয়েটাকে কে সময় দেবে, অ্যা?

মাঝে মাঝে আমেদের বলতে ইচ্ছা করে, কেন... তুমি দেখবে? ছবি থেকে আমার সাথে কথা বলতে পারছো আর মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছো না? দেখছো না মাকে পাবার জন্য কেমন ছটফট করছে মেয়েটা?

ছবিটা যেন আমেদের কথা বুঝতে পারে। ঘাড়টা বাঁকিয়ে বলে, বারে, দেখছি তো... গুনগুন কখন কী করে... কখন তার গল্প শুনতে ইচ্ছা করে কখন তার ছবি আঁকতে ইচ্ছা করে... সব... সব দেখছি তো! গুনগুন তো আমার লক্ষী মেয়ে... কোনো দুষ্টামি করে না!

আমেদের কণ্ঠ তখন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। বলে, তুমি যদি সবই দেখো তাহলে চলেই আসছো না কেন? দেখছো না তোমাকে ছাড়া আমার আর তোমার ওই লক্ষী মেয়েটার কেমন দিন কাটছে...

বাইরে তখন কোনো একটা বিজাতীয় পাখি লম্বা সুরে ডেকে ওঠে। আমেদের বুকটা যেন খালি হয়ে যায়। কেউ যেন শুষে নেয় সব। ছবিটা তখন স্থির। কোনো কথা বলে না। কোনো উত্তর নেই। ছবিটা দেখতে দেখতে কেমন ছাপসা হয়ে যায়।

আমেদ হাঁপাতে থাকে। ছয়তলায় উঠেছে। তার মুখে কষ্টের ভেতরেও হাসি ফুটে ওঠে। ফুলহাতা শার্টের হাতাটা গুটিয়ে ঘড়িটা দেখে নেয়। এগারটা পঁয়ত্রিশ। কলিং বেলে চাপ দেয় আমেদ।

যেন প্রস্তুতি ছিলেন আমেদ মা আয়েশা বেগম। চট করে দরজা খুলে দেন তিনি। আমেদ তাড়াতাড়ি বলে, কী করছে?

আয়েশা বেগম বলেন, কী আর... তোর অপেক্ষা... জানিসই তো সব, তারপরেও এত দেরী করিস কেন?

আমেদ পায়ের জুতোর ভেতর তর্জনী চালিয়ে জুতোটা খুলতে থাকে। বলে, এমনি এমনি কি দেরী করি মা? কত যে ঝামেলা... অফিস তো না যেন...

পাশের ছোট্ট র্যাকে জুতোজোড়া রেখে ভেতরে এগিয়ে যায় সে। কাছেই ডাইনিং টেবিল। চারটা চেয়ার তাতে সাজানো। রোদেলা যে চেয়ারে বসতো সেখানে গুনগুন বসে আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা খাতার ওপর ঝুঁকে কী যেন করছে। আমেদ এগিয়ে যায়। বলে, মা, কী করছিস?

গুনগুন ভ্রু কুচকে মাথাটা তোলে একবার। ঠোঁটের কাছে পেনসিল নিয়ে বলে, শশশ বাবা, আমি এখন বিজি...!

আমেদ বলে, কী নিয়ে বিজি মা?

গুনগুন ততক্ষণে আবার মাথা গুঁজে দিয়েছে খাতায়। বিরক্ত কয়ে বলে, উফ বাবা তুমি না অনেক কথা বলো... যাও আগে হাত-মুখ ধুয়ে আসো... তোমার জন্য খাবার নিয়ে বসে আছি...

একেবারে যেন রোদেলা, ভাবে আমেদ। যদি এটা সিনেমা হতো এক্ষুনি হয়তো একটা ফ্ল্যাশব্যাক দেখাতেন স্ক্রিপ্ট রাইটার। দেখাতেন এই ডাইনিং টেবিলেই, ওই গুনগুনের চেয়ারে বসে আছে রোদেলা। হাতে হয়তো একটা ম্যাগাজিন, নাহলে হুমায়ূন আহমেদের বই। আর সেই বইয়ের পাতা থেকে চোখ না তুলে রোদেলা বলছে, কী এত হাতিঘোড়ার কাজ করো বলো তো... রাত পার করে ঘরে ফেরা! যাও তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে আসো... খাবার একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেল বোধহয়!

আমেদ বাথরুমের দিকে যায়। তার একবার ইচ্ছা করে গুনগুনের খাতার দিকে উঁকি দিতে। অনেক কষ্টে সে ইচ্ছা দমন করে নেয়। ওই যে ছবি থেকে রোদেলা সব দেখছে-- সে আবার পড়ে বলবে লুকিয়ে লুকিয়ে এভাবে মেয়ের খাতা চেক করা আবার কেমন স্বভাব?

আমেদ বলবে, আরে চেক করা না... কৌতুহলটা দমন হচ্ছিল না... তাই...

রোদেলা বলবে, তোমার কাছে সবসময় এক্সকিউজ থাকেই না! এই তোমার কাছ থেকে শিখে শিখে না আমার মেয়েটার উঁকি দেয়ার বাজে স্বভাবটা হয়!

তারপর রোদেলা হয়তো কিছুক্ষণ আর কথাই বলবে না! শূন্য দেয়ালে নিরর্থক এক ছবি হয়েই অনেকক্ষণ ঝুলে থাকবে। সরু বারান্দা ধরে আসা শীতের বাতাসটাও তাকে কাঁপাবে না। আর এমন হোক তা কখনো চায় না আমেদ। তাই উঁকি না দিয়ে বাথরুমে গিয়ে কলটা ছাড়ে। পানির ঝাপটায় চোখমুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখে আয়েশা বেগম খাবার বেড়ে দিয়েছেন টেবিলে। কিন্তু গভীর মনোযোগে এঁকে যাচ্ছে গুনগুন। আমেদ বলে, মা তোর হয় নি? আমার তো অনেক খিদা পেয়েছে রে...

চট করে গুনগুন উঠে দাঁড়ায়। বলে, কমপ্লিট।

আমেদ বলে, কী কমপ্লিট করলি তাড়াতাড়ি বল... এক্সাইটমেন্টে তো আমার দম আটকে আসছে... 

ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে আসে গুনগুন। খাতাটা বাড়িয়ে দেয়। বলে, আমাদের ফ্যামিলির ছবি আঁকলাম বাবা, এই যে...

গুনগুন তার ছবিটা দেখায়। সেখানে একটা ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে চারটা মানুষ। গুনগুন তার ছোট ছোট কোমল আঙুল দিয়ে দেখায়-- এই যে বাবা তুমি এটা আর তোমার পাশে আমি... আর ওই পাশে ওই যে ওটা মা... আর এই পাশে এই খয়েরি শাড়ি পরে দিদি।

আমেদ আয়েশা বেগমের দিকে তাকায়। আয়েশা বেগম হাসেন। বলেন, নে, এবার তোরা বাপ-মেয়ে খেয়ে নে তো!

আমেদ ছবিটা নিয়ে একবার দেখে ভালোমতো। দেয়ালে টাঙানো রোদেলার ছবিটার দিকে তাকায়। গুনগুন বলে, বাবা, তুমি আর মা পাশাপাশি দাঁড়ালে কে বেশি লম্বা হতো বলো তো? দিদি বলছে তুমি... কিন্তু আমার মা তোমার থেকে উঁচু তাই না বাবা?

আমেদ ছবিটা নামিয়ে রাখে। বলে, হ্যাঁ মা, তোমার মা আমার থেকে অনেক উঁচু...

গুনগুন বলে, আচ্ছা বাবা, এই ছবিটা মার কাছে কীভাবে পাঠাবো বলো তো? আমি তো ছবিটা মার জন্যই এঁকেছি...

আমেদ বলে, তোর মা তো মেঘের ওপাড়ে থাকে বাবা... এই ছবি তো সেখানে যাবে না! তুই বরং জমিয়ে রাখ সব ছবি!

গুনগুন বলে, আচ্ছা।

তারপর ছবিটা নিয়ে ভোঁ দৌড় দেয় ঘরে। ওয়ারড্রোবের নিচের ড্রয়ারটা গুনগুনের দখলে। সেখানে সে ছবিটা ভাঁজ করে রেখে দেয়। আমেদ দেয়ালে টাঙানো রোদেলার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে, রোদ, একদিন তুমি মেঘ থেকে নেমে এসো!

(ক্রমশ...)



 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন