শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৪

তাদেরও একটা প্রেমকাহিনি ছিল


তার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল দুপুরে। অথচ কথা ছিল সকালেই দেখা হবার। হয় নি। হয় নি আমার খেয়ালেই। আমি যাই নি।

যাই নি কারণ আমি ভেবেছিলাম সে আসবে না। আসবে না ভাবার অনেক কারণ ছিল। আমার মতো এক ছেলের সাথে কেন তার মতো মেয়ে দেখা করবে তা আমার মাথায় ঢোকে নি। ফলে তার আর আমার যে কমন বন্ধু, স্নেহা, তার কথা আমি বিশ্বাস করি নি। ভেবেছিলাম সে ফাজলামি করছে। সুন্দরী মেয়েরা অসুন্দর ছেলেদের নিয়ে নানা হৃদয়বিদারক ফাজলামি করে-- এরকম কথা হুমায়ূন আহমেদ বইয়ে বইয়ে বলেছে; যেহেতু আমি অসুন্দর কিছুটা ছিলাম কিন্তু তারোধিক সুন্দর ছিল স্নেহা; ফলে এইসব কথা খুব মনে রাখতাম। বন্ধু হলেও আমি স্নেহার সৌন্দর্য ভুলে থাকতে পারতাম না। সে কেমন কেমন করে জানি কথা বলতো, মনে হতো কথায় কোমল স্নেহ মাখিয়ে দিচ্ছে, উড়িয়ে দিচ্ছে কথা, ঘুরিয়ে দিচ্ছে কথা। আর আমার হৃদয়ের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে। আর তার বাহু থেকে গ্রীবা থেকে চিবুক থেকে আলাদা আভা ছড়াতো। বুঝতাম ওইটাই রূপ। ওইটাই সৌন্দর্য। স্নেহা সুন্দর, তাই জানতাম সে আমাকে নিয়ে অনেক ফাজলামি করতে পারি, করতেই পারে। এসব ছিল নিপাতনে সিদ্ধ। আমি স্নেহার সকল হৃদয়বিদারক ফাজলামি হাসিমুখে মেনে নিতাম। সেদিনও নিয়েছিলাম।

তখন এমন মোবাইল কিন্তু ছিল না। আমি নাইনে উঠেছি মাত্র। এত বেশি ভাবতেও পারি না। স্নেহা বলে, যেও তুমি। ও কিন্তু আসবে ওই নদীর পাড়ে, ঘাটের যে সিঁড়ি শেষ হয়ে যায় আর ভাঙা একটা পাড় থাকে, ওখানে সে বসে থাকবে... তুমি যেও...

তখনও বান্ধবীরা তুই বলা ধরে নি। আর আমি তো এখনো বলতে পারি না। আমি তাই তোতলাতে তোতলাতে বলছিলাম, ক্যান, ওখানে আসবে ক্যান?
স্নেহা চোখ পিটপিট করে বলেছিল, তা তো সে-ই বলতে পারবে... আমি কী জানি? কিন্তু কী জানি কথা আছে তার তোমার সাথে?

চিন্তায় আমার কপালে ভাঁজ পড়ে। আমার সাথে কথা? তার? অসম্ভব। কোনো মেয়ে আমাকে গোপনে কোনো কথা বলতে পারে তা আমার ধারণারও বাইরের ব্যাপার। আমি তাই ফেলুদা হই। বলি, স্নেহা ক্যান মিথ্যা বলছো?

স্নেহা ব্রু কুচকে ফেলে। বলে, মিথ্যা? তো ঠিক আছে... মিথ্যা তো মিথ্যা... না গেলে যাবা না...!

স্নেহা চলে যায় সন্ধ্যাটা করুণ করে। আর আমার একটা রাত নির্ঘুম কাটে। যারা জেগে রাত কাটাতে পারে না তারা জানে নির্ঘুম রাত কী দুঃসহনীয় হয়। বিছানায় শুয়ে ছটফট আর বারবার পাশ ফেরা। বুকের কাছে কাঁথা টেনে নেয়া আর বারবার ফেলে দেয়া। মনে হয় এই রাত কবে হবে শেষ!

শেষ হয়। ভোর হয়। আজান শোনা যায়। বাড়ির লোক কেউ কেউ ওঠে। কলপাড়ে পানি তোলার শব্দ হয়। ঝাঁট দেয়ার শব্দ। শুকনো পাতা গড়িয়ে যাবার শব্দ। সব শব্দ একেবারে কানের ভেতর বারুদ জ্বালায়। কিন্তু আমি উঠি না। আমার ক্লান্তি লাগে। স্নেহা বলেছে আজ সেই ঘাট শেষে সিঁড়ির কাছে নদীর পাড়ে যেখানে শরতে আসলে দেদার কাশফুল ফোটে আর নৌকাগুলো বেঁকে যায় সেখানে সে আসবে... আমার সাথে দেখা করতে চায় সে... আমাকে কী যেন বলবে...

বিশ্বাস হয় না। সুন্দরীর ফাজলামি ভেবে শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ। স্কুল ফাঁকি। পড়ার কোনো তাড়া নেই। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবি। যদি সত্যিই আসে। ভয় হয় খুব। বুক ঢিব ঢিব করে। আমি যাই না। যেতে আমার সাহস হয় না। কিন্তু যাবার ইচ্ছাটাও থাকে। মনে হয় স্নেহাকে গিয়ে ডাকি। এই তো দুঘর পরেই বাড়ি। ডেকে বলি তুমিও চলো না আমার সাথে।

কিন্তু স্নেহাকে ডাকতেও ভয় হয়। আমার সকালটা কেমন চিনিহীন পায়েসের মতো হয়ে যায়। আম্মা বলেন, কীরে কী হয়েছে তোর? মুখ এরকম কেন?

আমি মুখ আরো শুকিয়ে ফেলি। বাড়ির ভিতরে প্রেতের মতো হাঁটি। যেন আমি আছি, কিন্তু আমি নেই। যেন ঘরের দেয়ালগুলো ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। আবার ঢুকে যাচ্ছি।

স্নেহা বলেছিল, খুশি আমাকে দেখেছে এই তো কদিন আগে। গার্লস হাই স্কুলের সামনে যেদিন ক্রিকেটের ব্যাটটা নিয়ে গেছিলাম, বল খোঁজার নামে, আসলে একটা ভোঁ চক্কর দেয়ার ইচ্ছায়। খুশি আমাকে আগে দেখে নি কারণ খুশিরা এসেছে বদলি হয়ে এই মাঝ বছরে। আর দেখেই নাকি...

স্নেহা এমন বদ, সবটা বলে না। খালি মুচকি মুচকি হাসে। কিন্তু খুশি আমাকে ডাকে কেন? নাকি খুশির কথা শুনে আমার চোখে কোনো চমক দেখে স্নেহা এমন একটা ফাঁদ পেতেছে। সেখানে গিয়ে হয়তো দেখা যাবে স্নেহারাই বসে আছে। আর আমাকে হাতেনাতে ধরে খুব হৈহট্টা করছে। নাহ, যাবো না!

না, যাবো না বলেও কিন্তু যাই আসলে। তবে সেটা বেলা গড়িয়ে। সকালটা পেরিয়ে। ঝা দুপুরে। একটা টিশার্ট আর সবচেয়ে ভালো যে প্যান্ট সেটা পরে। মুখে বড় আপার ফেয়ার এন্ড লাভলিটা লুকিয়ে মেখে। গিয়ে শেষ সিঁড়িটার ওখানে দাঁড়াই। উঁকি দিতেই দেখি পনিটেল। ধক করে ওঠে বুক।

সত্যি খুশি... সত্যি?

মুখ ফিরিয়ে আছে। তার পিঠে স্কুলের নিল কামিজ ঢিলঢিল করছে। ভেতরে সাদা। ওড়না সাদা। তাহলে সত্যি? আমার গলা কেঁপে যায়... ডাকি, খুশি...?
খুশি ঘুরে তাকায়। আর তার কোলের কাছ থেকে, হঠাৎই একটা সাদা বেড়ালছানার মতো বেরিয়ে আসে রঞ্জু। খুশিদের মতোই এইটে পড়ে। আমাকে দেখে খুশি আর রঞ্জু একসাথে বলে, মিঠু ভাই... আপনি?



আমি হাসতে চাই, হাসতে পারি না। কথা বলতে চাই, বলতে পারি না। আমার তখন খুব স্নেহার কথা মনে হয়। যেন সে খুব হাসছে। আর পুনর্ভবা খলবল করে উঠছে। সে হাসিতে আমার রাগ হওয়ার কথা, কিন্তু আমার ভেতর ঝমঝম করছে, মনে হচ্ছে পরিত্যক্ত ওই রেললাইন দিয়ে চলে যাচ্ছে ভারতীয় ওয়াগান। ঝমঝম ঝমঝম!
স্নেহা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন