শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৪

খানেদ আম্পায়ার















১. 

খানেদ আম্পায়ারের নাম তার বাবা রেখেছিল- খালেদ হোসেন। বুলি ফোটার পর দেখা গেল খানেদের 'ন'-এর প্রতি আলগা আকর্ষণ আছে। কেউ তার নাম জিজ্ঞেস করলে বলে, খাঁনেদ। বড় হওয়ার সাথে সাথে খ-এর ওপরের চন্দ্রবিন্দু বিলুপ্ত হলেও 'ন' আর  হয় না। নিজের পরিচয় সে খানেদ বলেই দিতে থাকে।

কিন্তু তাই বলে... আম্পায়ার?

খানেদের যে-গ্রাম ক্রিকেট সেখানে সহজে পৌঁছানোর কথা ছিল না। বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি জেতার আগে তা পৌঁছায়ও নি। ওই ট্রফিটা জয়ের পর বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ক্রিকেটের সত্যিকারের সুনামি বয়ে গেছে, এবং তাতে শিবরামপুর নামের গন্ডগ্রামও যে ভেসে গেছে তার প্রমাণ এই খানেদ আম্পায়ার।

বয়স তখনো তার অল্পই, লুঙ্গি না পরলেও চলে; তবু সবুজ চেকের একটা লুঙ্গি পরে সে নাড়া পোড়ানো ন্যাড়া মাঠে ক্রিকেট খেলত; এবং দেখা গেল ক্রিকেটের আইনকানুন রপ্ত। কী করে রপ্ত? চেয়ারম্যান বাড়িতে তখন একটা টিভি-- আর সেই টিভিতে, বিটিভিতে প্রচারিত ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার খেলাগুলো তীক্ষ্ণভাবে দেখতো খানেদ। অবশ্য দেখতো অনেকেই, কিন্তু দেখতে দেখতে বুঝতো বা বুঝতে বুঝতে দেখতো একমাত্র খানেদই। অন্যকেও বোঝাতো। কতোবার চেয়ারম্যানই চিৎকার করে বলেছে, পায়ের গোড়া দিয়া বল গেল এইটা ওয়াইড ক্যানবে? মুখের সামোন দিয়া গেলে তো কিছু হয় না! ওই খানেদ্দা, এইটা কী?

খানেদ বোঝাতো ওয়ানডের নিয়ম এরকম সেরকম। চেয়ারম্যান গজগজ করতো। খুব বেশি রেগে গেলে ওয়ানডে ক্রিকেটের বাপ-মা তুলে গাল দিতো!

খানেদ চেয়ারম্যানের ঝিলমিল ঝিলমিল রঙিন টিভিতে ওয়ানডে, কখনো কখনো টেস্টও দেখতো। আর তার একটা রেডিও তো ছিল। তাতে ভুলভাবে শুদ্ধভাবে সে খেলা শুনতো। দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে ক্রিকেটের রীতিনীতি মোটামুটি রপ্ত করে নিয়েছিল সে। অথচ, বেচারা খানেদ, ক্রিকেটটা খেলতে পারতো না। তিনটা স্ট্যাম্পের গোড়ায় দাঁড়িয়ে যখন সে অদ্ভুতভাবে ব্যাট ধরতো (শিবরামপুরে সবাই অদ্ভুতভাবেই ব্যাট ধরতো, সেটা ধর্তব্য নয়) দেখে মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজটা খানেদ করছে। সাধারণত দুটো ঘটনা ঘটতো- হয় তার ব্যাট আগে চলে যেতো, বল এসে পৌঁছাতো দেরিতে; না হয় বল আগে চলে যেত, ব্যাট ছুটতো পরে। এ সময়ে মাঠ ঘিরে থাকা গ্রামের দর্শকরা, যারা কোনোদিন ব্যাট ধরেও নি, তারাও ‘হুক্কা হুক্কা’ বলে চিৎকার করতো। ক্রিকেট জানা খানেদের জন্য এটা ছিল যথেষ্ট অপমানের।দুই দল ভাগ করার সময় খানেদকে ‘লুচপুচি’ রাখা শুরু হতেই খানেদ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ক্রিকেট সে চিরকালের মতো ছেড়ে দেবে!
... এরকম একটা সময়ে খানেদের সাথে নিয়তির দেখা হলো। খানেদ তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ করে পড়ালেখার সাথে তালবাহানা শেষ করার কথা ভাবছে... সে ধরেই নিয়েছে একটা জীবন ক্রিকেট দেখেশুনে পার করে দিতে পারলেই স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটবে। তার মাথায় ঘুরছে শচীন টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরাম, ব্রায়ান লারা। খানেদের স্বপ্ন তাদেরকে সে চর্মচোখে দেখবে, তাদের অটোগ্রাফ নেবে। তাতে জমি চাষে হাত লাগানোর কথা বলে তার বাপ যতোই বাধা দিক!

তখন পাশের গ্রাম আলীনগরের সাথে শিবরামপুর একটা বাজির ম্যাচের আয়োজন করল এক শুক্রবারে। যে দল জিতবে সে পাবে দুইটা নর-রাজহাস। খেলা সেই নাড়া পোড়ানো ন্যাড়া মাঠে। নামাজ পড়ে মানুষজন টুপি মাথায় চলে এল খেলা দেখতে। পনের ওভারের খেলা। টেনিস বল। বল নিয়ে আসা হয়েছে রহনপুরের টেনিস কোর্ট থেকে। ইচ্ছা থাকলেও খানেদের জায়গা হলো না দলে। সে তখন পাকুর গাছের নিচে বসে বসে খেলা দেখার আয়োজন করে। যদি দলে নেয় এমন ভেবে খানেদ তার একমাত্র খাকি প্যান্টটা পরে এসেছিল, হলুদ রঙের একটা গেঞ্জিও পরেছিল। এখন হতাশ হয়ে নিজের গ্রামের সমর্থক হওয়া ছাড়া কোনো কাজ তার নাই। হঠাৎ মাঠে গোল বাধে আম্পায়ারিং নিয়ে। কে কবে কাকে বাজে আউট দিয়েছিল এ নিয়ে বিস্তর ট্যা-ফোঁ যখন হচ্ছে মাঠে, মাঠের বাইরে খেলা দেখতে আসা চেয়ারম্যান তখন সবাইকে শান্ত করে বলল, খানেদ্দা আম্পায়ারি করুক…তাইলে তো আর ঝামেলা থাকে না।

আলীনগরের বাসিন্দারাও কীভাবে কীভাবে যেন জানতো যে খানেদ খেলাটা ভালো বোঝে। তারা রাজি হয়ে গেল। ঠিক হলো, আম্পায়ারকে রাজহাসের ভাগ দেয়া হবে। খানেদ সেই প্রথম আম্পায়ার হিসেবে মাঠে দাঁড়ালো। তখন সেও জানতো না আগামী ক’বছরে এ আম্পায়ারিং তাকে কতো কিছু দেবে, আবার কেড়েও নেবে!



২.

খানেদ যে ভালো আম্পায়ার, বিশ্বস্ত তার সিদ্ধান্ত, ক্রিকেটের আইনকানুন জানা ব্যক্তি এটা রহনপুর ছাপিয়ে জেলা সদর পর্যন্ত ছড়ালো। অন্য খেলোয়াড়রা যখন ক্রিকেট খেলার জন্য খ্যাপ পায়, খানেদ তখন খ্যাপ পায় আম্পায়ারিং করার জন্য। টুর্নামেন্ট শুরু হলেই আয়োজকরা আগে থেকে খানেদকে ঠিক করে। বলে ম্যাচগুলা খেলায়ে দিয়েন খানেদ ভাই…ম্যাচ প্রতি বিশ টাকা।

খানেদ দামদর করে। বিশকে পঁচিশ করে। খানেদ, খানেদ আম্পায়ার হিসেবে দিক পায়।

আন্তজেলা টুর্নামেন্টে আম্পায়ারিং করার জন্য খানেদ ডাক পায় অবশেষে। খানেদ মনে মনে ভেবেছিল এখানে খেলাবে। এখানে দেশের বড় বড় তারকা প্লেয়ার খ্যাপ খেলতে আসে।

প্রথম ম্যাচ খেলাতে গিয়েই খানেদের বুকে তোলপাড়। পাইলট! ছক্কা পাইলট! এর একটা ছক্কাতেই বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়েছে। এতকাল টিভিতে দেখেছে ভাঙাচোরা গাল, পাতলা সাতলা শরীর; মুখোমুখি দেখে খানেদের আক্কেলগুড়ুম- টিভির পাইলটের থেকে বাস্তবের পাইলট বেশি সুন্দর।

পাইলট উইকেট কিপিং করল না। প্যাড ছাড়া কাভারে ছটফট করে ফিল্ডিং করল। এটাও খানেদের জন্য বিস্ময়। সে ভেবেছিল উইকেট কিপাররা প্যাড গ্লাবস ছাড়া ফিল্ডিং করতে পারে না। অথচ পাইলট সামনে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত ক্যাচ নিলো একটা, আরেকটা বল স্ট্যাম্পে এতো জোড়ে থ্রো করল যে স্ট্রাম্প উপড়েই গেল। সময়মতো সরে না গেলে খানেদের ঠ্যাংও উপড়ে যেতো! খানেদের মনে হলো, অবিশ্বাস্য!

ওয়ানডাউনে নেমে পাইলট উনপঞ্চাশ রানে আউট হলো। এলবিডাব্লিউ। আউট দিলো খানেদ। তর্জনী শূন্যে তোলার আগে বুকটা একটু কেঁপেছিল খানেদের। স্বপ্নের তারকাকে হাফ সেঞ্চুরি থেকে বঞ্চিত করবে কিনা এমন একটা দ্বন্দ্ব তার ভেতর নিমিষে খেলে গিয়েছিল; কিন্তু সে আম্পায়ার, সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়াই তার কাজ, তর্জনী ওঠাতে তাই সে বেশি দেরি করে নি।

পাইলট কিছুক্ষণ পিচে দাঁড়িয়ে, বিস্ময় নিয়ে খানেদকে দেখে, মাঠ ছেড়েছিল এবং পাইলটের দল হেরেছিল।

খেলা শেষে খানেদের খুব ইচ্ছা ছিল পাইলটের সাথে কথা বলার। কিন্তু কাকে বললে এ সুযোগ হবে বুঝতে না পেরে যখন সে মাঠ ছাড়ছে তখন পেছন থেকে কে যেন ডাকলো তাকে।

‘এই যে, কী নাম আপনার?’

খানেদ পেছন ঘুরে দেখে পাইলট। চুইংগাম চিবাচ্ছে। খানেদ যেন ধন্য হয়ে গেল। হড়বড় করে বলল, খানেদ…খানেদ হুসেন!

‘খালেদ, বাহ…আমিও তো খালেদ…খালেদ মাসুদ। মিতা হয়ে গেলেন।’ পাইলট আটকে আটকে কথা বলে। বলার মধ্যে অকারণ দ্রুততাও আছে।কিন্তু খানেদের কান এমন শুনে অভ্যস্থ। পাইলটকে কতবার কথা বলতে শুনেছে সে টিভিতে। কিন্তু পাইলটের কথায় খানেদ কী উত্তর করবে বুঝতে পারে না।

‘আপনি তো ভালো আম্পায়ার…আমার এলবি’র ডিসিশানটা ভালো দিছেন। অন্য কেউ হলে দিতো না। কী করেন?’

খানেদ কিছু তো করে না। ক্রিকেট নিয়েই মেতে থাকে। সেটাও কি বলা যায়?

পাইলট একটা কার্ডে ব্যক্তিগত ফোন নাম্বার লিখল। সেটা দিতে দিতে বলল, ঢাকায় এলে যোগাযোগ কইরেন। আপনি ক্রিকেট ভালো বুঝেন!

কার্ডটা নিয়ে খানেদ কোনোমতে বলতে পারল, একটা সাইন যদি দিতেন…

পাইলট হাসতে হাসতে অটোগ্রাফ দিল। খানেদ এক জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বুক পকেটে নিয়ে মাঠ ছাড়ল।


৩. 

পরের ক’বছরে খানেদ বিভাগীয় টুর্নামেন্টগুলোর কয়েকটা ম্যাচে আম্পায়ারিং করতে পেল। রাজশাহীতে একটা মেসবাড়িতে সে থাকতেও শুরু করল। ক্রিকেট দেখা, ক্রিকেটের বই পড়া তার ধ্যান জ্ঞান। কোনো কিছু করার না থাকলে খানেদ স্টেডিয়ামে গিয়ে ক্রিকেট প্রাকটিস দেখত, বাইরে থেকে বুঝতে পারতো কোন ব্যাটসম্যানের পা চলে না, কোন ব্যাটসম্যানের এলবোতে ঝামেলা। কিংবা কোন বোলারের রানআপটা আরেকটু অন্যরকম হলে আরো ভালো হয় ইত্যাদি।

খানেদের অন্যান্য বন্ধুবান্ধবেরা অনার্স পাশ করেছে, খানেদ ভর্তি হয়ে আছে কিন্তু পাশ করতে পারছে না। মনোবিজ্ঞান নামের একটা সাবজেক্ট সে নিয়েছিল এই ভেবে যে এতে খেলোয়াড়দের মানসিকতা সে ধরতে পারবে। লাভের লাভ হয় নি। কিছু বেহুদা তত্ত্ব ছাড়া বইয়ে কিছু নেই। আগের মতোই খানেদের মনেহয় একটা জীবন পড়ালেখা নামের বাজে জিনিসের পেছনে সে কাটিয়ে দিল- ক্রিকেটের কিছুই হলো না!

এর মধ্যে খানেদের বাপ মারা গেল। মৃত্যু সংবাদ যখন সে পেল তখন একটা দলের ব্যাটিং শেষ হয়েছে, লাঞ্চব্রেক চলছে। খানেদ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে সাথে সাথে রওনা দিল গ্রামের উদ্দেশ্যে। জ্ঞান হওয়ার আগেই মাকে হারিয়েছিল খানেদ, মায়ের কবরটাও দেখেনি সে- নদীতে নিয়ে গেছে। বাপের মৃত্যুতে নিজ হাতে কবর দিতে পারাটাই শুধু স্বান্তনা হয়ে থাকলো।

চাষের জমি তাদের বেশি ছিল না, কিন্তু সংসারে আর কেউ না থাকায় ওই জমিটুকুতেই খানেদের বেশ চলে যেত। কিন্তু সে তো গ্রামে থাকলো না। ফলে তার জমি শরিকদের বেহাতে যাওয়ার উপক্রম হলো।

খানেদ অবশ্য গুরুত্ব দিল না। তার কাছে জমি মানে বাইশ গজের পিচ।

একদিন খানেদের নামে চিঠি এল। আম্পায়ার তৈরির একটি প্রক্রিয়া শুরু করছে বিসিবি…খানেদ তাতে যোগ দিতে চায় কিনা!

বুক ভরে গেল খানেদের। সে চায়, অবশ্যই চায়। বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট ম্যাচ সে খেলাবে…শচীন-লারা-মুরালিরা খেলবে…আশরাফুল-সুমন-পাইলটরা খেলবে…এই তো তার স্বপ্ন।

ব্যাগ-বোকচা গুটিয়ে ঢাকায় ছোটে খানেদ।

ঢাকায় এসে খানেদ অবশ্য দিকহারা হয়ে পড়ে। চিঠি নিয়ে যোগাযোগ করলেও তেমন উৎসাহব্যঞ্জক কিছু শুনতে পায় না। এই প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে নির্দিষ্ট কোনো তারিখ এখনো স্থির হয় নি। বিসিবি প্রধান অস্ট্রেলিয়ায়, তিনি এলে স্থির হওয়ার সম্ভাবনা আছে। পাইলটের নাম্বারটার কথা মনে পড়ল খানেদের। মূল্যবান তাবিজের মতো করেই সে কার্ডটা যত্ন করে রাখে। কিন্তু ওই নাম্বারে ফোন করেও তো লাভ হবে না। বাংলাদেশ দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গেছে। প্রথম টেস্ট চলছে। উইকেটের পেছনে পাইলটই কান্ডারী!

মিরপুর স্টেডিয়ামের পাশে ছোটখাটো এক মেসবাড়িতে ওঠে খানেদ। খুব বেশি টাকাপয়সা তার কাছে নেই, থাকার কথাও না। কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা ঢাকায় কেউ তাকে চেনে না, সেও কাউকে চেনে না।

একদিন স্টেডিয়ামে ঢুকতে গিয়েও ঢুকতে পারে না খানেদ। সাধারণের প্রবেশাধিকার নাকি নেই। চিঠি নিয়ে আরো কয়েকবার যাতায়াত করে দপ্তরে। শেষবার শুনতে পায় আম্পায়ার তৈরির প্রক্রিয়া নাকি বন্ধ আছে, পরে কোনো এক সময় হবে। হলেই খানেদ খবর পাবে।

খানেদের ফিরে যাওয়াই উচিত ছিল। সে ফিরেও গেল। তার এলাকাজুড়ে রাষ্ট্র হয়ে আছে যে ক্রিকেটের জন্যে ঢাকা থেকে ডাক পেয়েছে সে। রসালো আমকে মাছি যেভাবে ঘিরে ধরে, খানেদকে তেমনি ঘিরে ধরলো এলাকাবাসী। কত জনের কত রকমের প্রশ্ন! কেউ জিজ্ঞেস করে, আকরামের সাথে দেখা হয়েছে কিনা? দেখা হলে হাত মিলিয়েছে কিনা? সে কি টিভিতে যেমন দেখায় তেমনি নাকি আরো মোটা? কেউ জিজ্ঞেস করে, দাঁত ভাঙার পর পাইলট দেখতে কেমন হয়েছে? কথা বললে থুতু ছিটে কিনা? ইত্যাদি ইত্যাদি।

একজন  দুম করে বলে বসল, এ মামুর বুটা কাহুকেই দ্যাখেনি বে…ঝুটাঝুট্টি!

ফলে খানেদকে সাদা ক্যারিবিয়ান টুপিটা দেখাতে হলো। জানাতে হলো এটা ছিল সুমনের। তার আম্পারিং-এ মুগ্ধ হয়ে টুপিটা সুমন উপহার দিয়েছে।

জনতা শান্ত হলো। কেউ কেউ জানালো, তারা আগে থেকেই জানতো যে খানেদ আম্পায়ার এমন একটা কাজ করবেই করবে।

একজন প্রবল বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল, টিভিতে তুমাকে কখন দেখতে পাবো?

টুপির ব্যাপারে মিথ্যা বলার পর আরো মিথ্যা কথা বলতেই পারতো খানেদ। আরো অনেক গল্পর বানাতে পারতো সে। কিন্তু তা না করে বলল, আরো ভালোমতো আম্পায়ারি শিখতে হবে…তাইলে আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেলানোর হুকুম দিবে! তখন দেখতে পাবি!

ছোকরা মতোন একজন  বলল, টিভিতে যে বুটারা আম্পায়ারি করে তুমি তো তাদের থেক্যা ম্যালা ভালো করো…

এই বিশ্বাসটা খানেদেরও ছিল। সে জানতো আইসিসি প্যানেলের কিছু আম্পায়ারের থেকে সে ভালো আম্পায়ারিং করতে পারবে। আর  ওই বিশ্বাসের জোরেই সে তার শেষসম্পদ জমিটুকু বিক্রি করে দিলো শরিকদের কাছে। আম্পায়ারিং তাকে আরো শিখতে হবে, আর  আরো শিখতে হলে ঢাকায় থাকতে হবে, আর  ঢাকায় থাকতে হলে টাকার দরকার। তার জীবনের টাকার দরকার ওই ওইটুকুই।


৪. 

মিরপুরবাসী খানেদ উত্তেজনায় ঘুমাতে পারছে না। আগামীকাল তার টেস্ট অভিষেক। হ্যাঁ, এখন সে একজন  ভালো আম্পায়ার। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তিন জাতি টুর্নামেন্টের ওয়ানডে দিয়ে তার পথচলা শুরু। এ পর্যন্ত সাতটি ওয়ান ডে সে খেলিয়েছে। তার স্বপ্নের শচীন টেন্ডুলকার তারই সামনে ক্রিজে দাঁড়িয়ে তার কাছ থেকে গার্ড চেয়েছে। খানেদের তখন বুক ঢিবঢিব করছিল। একটু বামে ব্যাটটা সরাতে হাত-ইশারা যখন করছিল সে, তার মনে হচ্ছিল এখন যদি ভুল গার্ড দিয়ে ফেলে! তার একটু ভুলের জন্য কি শচীন আউট হয়ে যাবে?

শচীন সেদিন আউট হয় নি। স্বভাবসুলভ সেঞ্চুরি করে অপরাজিত থেকেছিল। অনেক বড় ব্যবধানে জিতেছিল ভারত।

মাঠভর্তি দর্শক আর  খানেদকে ঘিরে এতো তারকা যে খানেদের মাঝে মাঝে সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগে। এই রফিক তার সামনে এলবিডাব্লিউর আবেদন করছে, এই জয়সুরিয়া উড়িয়ে মারছে, এই সুমন ফিফটি করে ব্যাট উঁচিয়ে ধরেছে…

স্বপ্ন, সব যেন স্বপ্ন! কোথাকার কোন শিবরামপুর থেকে উঠে এসে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলাচ্ছে সে। আর  কাল খেলাবে প্রথম টেস্ট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভার্সেস বাংলাদেশ। লারাদের উত্তরসুরীদের সাথে সাকিব-মুশফিকরা!

ভোর হচ্ছে। খানেদ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার পা কাঁপছে, হাত কাঁপছে, বুক কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে সে ট্রাউজার-গেঞ্জি পরে, মাথায় চাপায় সাদা ক্যারাবিয়ান টুপি।

বাইরে নরোম আলো। দরজা খুলেই খানেদ যেন মিরপুর মাঠে প্রবেশ করে। সবুজ ঘাস শিশিরে ভেজা। চারপাশ ঘিরে দর্শকদের হৈ-চৈ। সাদা পোশাকের বাইশজন মাঠের মধ্যে। এই সাদার মতো উজ্জ্বল রঙেলা আর  কী আছে!

খানেদ তার পকেটে হাত দেয়। আছে, পাইলটের অটোগ্রাফ সম্বলিত সেই কার্ডটা তার পকেটে আছে। এই কার্ডটা সে কখনো কাছ ছাড়া করে না।

টসের জন্য মধ্য মাঠের দিকে এগিয়ে যায় খানেদ। তার সাদা জুতো শিশিরে ভিজে ভিজে যায়।



পাদটিকা:

বিচক্ষণ পাঠক একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন যে ৪ নম্বর অংশটি আমি বানিয়ে বানিয়ে লিখছি। যেন একটা স্বপ্নদৃশ্য। নিজের ঘরের দরজা ঠেললেই খানেদ পৌঁছে যাচ্ছে মিরপুরে... গ্যালারিভর্তি দর্শক তার প্রবেশে উল্লাস করে উঠছে! এমন তো হয় না আসলে...কিন্তু লিখতে লিখতে মনে হচ্ছিল, আহা এমনটাই যদি হতো! আমাদের শিবরামপুরের খানেদ যদি সত্যি আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হয়ে উঠতো!

কিন্তু খানেদ হয়ে ওঠে নি। জমি বেচে ঢাকায় স্থায়ী হতে চেষ্টা করেছিল সে। চেষ্টা করেছিল বিসিবির আম্পায়ার তৈরি প্রক্রিয়ার ভেতর প্রবেশ করতে। কিন্তু মিরপুর স্টেডিয়ামের গেইট পেরিয়ে ওই সবুজ মাঠে যেমন তেমনি অজানা কারণেই খানেদ সে প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকতে পারে নি।

অনেক অনেক সময় চলে যায়- ঢাকা চিরকাল অপরিচিতই থেকে যায় খানেদের কাছে; তারপর একদিন পরিচিত যে-গ্রাম, শিবরামপুর, সেখানে ফেরত আসে সে, চিরকালের মতো। এর মধ্যে একবার পাইলটের সাথে দেখাও হয় তার। আশ্চর্যের ব্যাপার, পাইলট তাকে চিনতে পারে। পাইলট তখন একটা একাডেমি প্রতিষ্ঠা নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। সেই একাডেমিতে একটা কাজও জুটিয়ে দিতে চায়। কিন্তু খানেদ কেন যেন রাজি হয় না। হয়তো আগের মতো আর  স্পৃহা পায় না।

খানেদ এখন নিজ বসতভিটায়, পেছনের ফাঁকা জায়গায়, সবজি চাষ করে। ছোট্ট একটা টিভি তার আছে। সকাল সন্ধ্যা তাতে ক্রিকেট চলে।

খানেদের সবজি বাগানে টেস্টের লাল বলের মতো টমাটো ফলে। ক্রিকেট স্ট্যাম্পের মতো চিচিংয়ে ফলে। বেগুন ফলে, ঢেরস ফলে। সকালবেলা সবজিগুলোর গায়ে বিন্দু বিন্দু শিশির জমে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে খানেদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

পাশের রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে হৈ-চৈ করতে করতে বাচ্চা-কাচ্চারা ইশকুলে যায়। খানেদকে দেখে তারা দাঁড়িয়ে পড়ে। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার আগে বাংলাদেশের পতাকাকে দেখে হাত তুলে তারা যেভাবে সালাম করে, একইভাবে খানেদের সামনেও তারা হাত তোলে, সালাম করে। সে সালামের উত্তর দিতে গিয়ে খালেদের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

ওইসব শিশুদের কাছে আমাদের সাধারণ খানেদ হলো বিশ্বসেরা খানেদ আম্পায়ার। পাকুর গাছের নিচের মাঠটাতে ক্রিকেট হলে তাই এখনো তারা খানেদকে ডাকে। খানেদ সে-ডাক কখনো উপেক্ষা করতে পারে না।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন