মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪

আবু নাসিম বা লখিন্দর কোনোটাই তার নাম ছিল না... (সাত)




সাত.

বাবুভাইয়ের পার্টি মধ্যরাত পেরিয়েও চলেছিল। কিন্তু বাবুভাই চলে যেতেই, যেমন হয় সচরাচর, পার্টিটা ঝিমিয়েও পড়েছিল। মেলা ভেঙে গেলে মাঠজুড়ে যেমন একটা শূন্যতা থাকে, ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে, পার্টিটাকে তখন তেমনই মনে হচ্ছিল লখিন্দরের। আর তার ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো ভিজে গিয়েছিল ঘামে। লখিন্দর ঘাম শুকাতে একটা প্রকাণ্ড এসির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের পাত্রের দিকে মন দিয়েছিল। কিন্তু চোখের কোণা দিয়ে সে, হয়তো অকারণেই খেয়াল রাখছিল রঞ্জনাকে।

বাবুভাই চলে গেলে রঞ্জনাও নড়ে ওঠে। একটা মুহূর্তের জন্য সে তাকিয়েছিল লখিন্দরের দিকে। সে দৃষ্টিতে কী ছিল, লখিন্দর চোখপড়া মানুষ হলেও ঠিক ধরতে পারে নি। তারপর এক পা এগিয়ে আমান খানের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও রঞ্জনা থমকে যায়। বলা যায় ছুটেই বেরিয়ে যায় সে। তার যাওয়াটা দেখে লখিন্দর। লখিন্দরের মনে হয় একটা বর্শা, তার সমস্ত গতি নিয়ে বেরিয়ে গেল, যেন আঘাত করবে লক্ষ্যকে। কিন্তু রঞ্জনার লক্ষ্য কী তা নিয়ে ভাবলো না লখিন্দর। এসব ভাবনা তার কাছে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নি। অথচ, আমরা এখন ভাবি, লখিন্দরের উচিত ছিল এসব ভাবনাকে গুরুত্ব দেয়া। যদি দিতো, আমরা মনে করি, লখিন্দরের প্রলম্বিত ছায়াটিকে এখন আমাদের আমান খানের মতো মনে হতো না। মনে হতো না বারান্দায় বসে মার্টিনি শুষে নেয়া লোকটি দীর্ঘ প্রলয় পেরিয়ে আসা লখিন্দর... যে হারতে হারতে জিতে যেতো প্রায় অলৌকিক উপায়ে। আর আজ সে যেন হেরেই বসে আছে। অপেক্ষা করছে বিজয়ীর। আর তার পানির ট্যাঙ্কের ভেতর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রঞ্জনা... ঘুমাচ্ছে বা জেগে আছে বা আসলে মরে গেছে! আমরা কোনোভাবেই রঞ্জনার এই পরিণতির কথা ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না লখিন্দরের এই নিষ্পৃহতা। রঞ্জনার ঠোঁটের কোণের রক্তবিন্দুগুলো ট্যাঙ্কের পানিতে ধুয়ে ধুয়ে যায়। ট্যাঙ্কের পানি দূষিত হয় ঠিকই কিন্তু তার অধিক দূষণ আমাদের মনে জমে যায়। আমরা দূষিত মন নিয়ে, দুর্ভার নিয়ে করুণা করেই যখন লখিন্দরের দিকে তাকাই, দেখি এসির সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে শুকিয়ে নিচ্ছে আমরা বিচলিত হই। ভাবি, হায় লখিন্দর... শরীর শুকানোর সাথে তুমি যদি তোমার মনটাও শুকিয়ে নিতে... যদি আরো একটু স্পষ্ট দেখার কথা ভাবতে তাহলে জানতে পারতে কী নিদারুণ এক ষড়যন্ত্র তোমার বিরুদ্ধে রঞ্জনার ওই দুধেল বিছানায় রচিত হচ্ছে। কামে আর ক্রোধে, গর্জনে আর বিসর্জনে, ভালোবাসায় আর ঘৃণায় গোখরার সহবাসের মতো লেপটে লেপটে রচনা হচ্ছিল লখিন্দরকে তার উচ্চতা থেকে এক টানে একেবারে অন্ধখাদে নামানোর এক ভয়াল ষড়যন্ত্র। আমরা সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে, যদিও দৃষ্টি দেয়াটা আমাদের উচিত হয় নি, আমরা শিউরে উঠি। থরোথরো কাঁপি। ভাবি তাহলে এই তো মানুষ আসলে। একটা শিশু যা নিয়ে আসে... ক্ষুধা আর তৃষ্ণা, হিংসা আর ঘৃণা, টিকে থাকবার নিদারুণ অভিপ্রায় আর তার বড় হওয়ার সাথে সাথে তার ভেতর যুক্ত হয় কাম... এই তো মানুষ... এর বাইরে তো সে কিছু নয়। এর বাইরে যা-কিছু ভালোবাসা আর বিনয়ের প্রলাপ তা তো এই সভ্যতার হাতুরি... এরাই মানুষ, যারা রঞ্জনার ওই দুধেল বিছানায় সঙ্গমরত, ষড়যন্ত্ররত, টিকে থাকবার বাসনারত... মানুষ তো এর বাইরে কিছু নয়। আমাদের দেখাটা তখন সত্যিকারের দেখা হয়ে ওঠে। আর আমরা ভাবি লখিন্দরও যদি এই দেখাটা দেখতে পেতো। বারবার ভাবি, যদি দেখতে পেতো যদি শুনতে পেতো... আহা যদি পেতো!

কিন্তু পৃথিবীর কিছু নিয়ম তো আছে। যার যখন যা দেখার শোনার জানার কথা, তার বাইরে, সে কখনোই তা দেখতে শুনতে জানতে পারে না। এই নিয়ম কে বানিয়েছে এমন ভেবেছে লখিন্দর খুব। আর এমন ভাবতে হাস্যকরভাবে তার শুধু শৈশবের আঁকা এক চোখঅলা দৈত্যের কথা মনে হয়েছে। দৈত্যটার শরীর মোটা আর থলথলে। একটা মাত্র চোখ আর সাথে মহিষের মতো একাকী শিং। আর এই এসির বাতাস খেতে খেতে তার মনে হলো সেই দৈত্যটা আসলে আমান খান। কিন্তু আমান খানের চোখ আছে দুটি-- পরক্ষণেই ভাবে লখিন্দর-- দুটি নাকি আসলে একটি? আর সারাক্ষণ ঢেকে রাখে সেই চোখ-- একটা গাঢ় সানগ্লাশ দিয়ে। লখিন্দর একবার আমান খানকে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করল তখন, কিন্তু তার ভেতরেও হুইস্কির একটা ভোঁদৌড় আছে। মনে হচ্ছিল একটা রকেটবাজি সা করে একবার মাথায় একবার তার পায়ের কাছে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। ফলে লখিন্দর একবার বমির কথা ভাবতে পারে, আর বড় জোর ভাবতে পারে পার্টিটা ছেড়ে চলে যাবার কথা।

কিন্তু যাবার কথা তখনো ভাবে নি আমান খান। আমান খানের নেশাটা একেবারে সপ্তমে। কিন্তু রঞ্জনাকে এমন বেরিয়ে যেতে দেখে তার ভ্রু কুচকে গিয়েছিল। বাবুভাই যে জ্বালাটা রেখে গিয়েছিলেন তা তার ভেতরে ছিল, তার দহনও ছিল ধিকিধিক, কিন্তু তাই বলে রাতটাকে তার শুষে নিতেও ইচ্ছা করছিল। আর ওই শোষণের ভেতর এক অদ্ভুত লকলকে বাসনা জাগ্রত হচ্ছিল তার। বাসনা কখনো কখনো নতুন ওই মেয়েটা, যার একটি ফিল্ম বেরিয়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে চুমকি, তার খোলা পিঠের কাছে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছিল। আমান খানের চোখ লাল হয়েছিল নিশ্চয়, কিন্তু গাঢ় সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে তা দেখার উপায় ছিল না। যেমন উপায় ছিল না ওই লকলকে লালসার চেহারাটা দেখার। মেয়েরা নাকি আগে থেকেই এসব টের পায়-- চুমকি হয়তো তাই বেশ কয়েকবার আমান খানের সামনে দিয়ে ঘুরে গেছে। আর আমান খানের ভেতরের লবঙ্গের ঘ্রাণতোলা ধূসর ফলাটা ফুঁসে ফুঁসে উঠেছে। দীর্ঘ সময় মদ্যপান করলে আমান খানের মাঝে মাঝে এমন হয়। সে বাসনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে। কিন্তু এই বাসনা আর চুমকির মাঝে ছিল রঞ্জনার মতো এক শক্ত ও লম্বা দেয়াল। আমান খান তাতে আরো উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। কিন্তু রঞ্জনা চলে গেলে, দেয়ালটা সরে গেলে, হঠাৎ সব স্তিমিত হয়ে পড়ে। যেন বাতাসভর্তি একটি বেলুন, একটা পিনের আঘাতে, হঠাৎ করেই চুপসে গেল। আমান খানের হৃদয় এবং ধূসর ফলা যেন নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়তে চায়। আর আমান খানের একটা হাই ওঠে। হাই উঠলে আমান খান সাধারণত একটা চুটকি বাজায়, কিন্তু আজ বাজাতে ইচ্ছা করল না তার। বরং কেমন একটা ঘোরলাগা চোখে রঞ্জনার যাবার পথটা দেখতে থাকলো। চুমকি তখন আরো একবারের মতো আমান খানের কাছে এসেছিল, একটা দুর্দান্ত ঘ্রাণ আমান খানের নাক দিয়ে হৃদয়ে যেতে চায়, কিন্তু আমান খানের দরজা-কপাট সব যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর কোনো কিছুই তার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। আর ভেতর থেকে কোনো কিছুই আর বাইরে আসতে চায় না!

তাহলে বাধাই কি আমান খানের বাসনার উৎস ছিল? আমান খান এসব ভাবে না, বরং তার ভেতর একটা শঙ্কা জন্ম নেয়-- রঞ্জনা কোথায় যাচ্ছে? চলে যাচ্ছে? একা যাচ্ছে? আমান খানকে ছেড়েই? তাহলে কি এত সাহস সে পেয়ে গেল এই এক লহমায়? পেয়ে গেল ওই লখিন্দরের সাথে কয়টা ফিল্মের কথা শুনেই? বাবুভাইয়ের ছায়াই কি এখন তার কাছে সব? আমান খান আর কিছু নয়? সুপারস্টার আমান খান তাহলে আর কিছু নয়?

ক্রোধ হয় আমান খানের। তাকে না বলে রঞ্জনার এই চলে যাওয়া তাকে বিক্ষত করে তোলে। সে তার গ্লাশটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারে। শব্দ তো হয় কিছুটা। কিন্তু ঘরভর্তি যে মানুষ তাদের কাছে এই শব্দের তেমন কোনোই গুরুত্ব নেই। কাচ কিছুক্ষণ পরপরই ভাঙছে হেথায়--- এখন মধ্যরাতের পর কেউ কারো কথা শুনবে না, কিছুক্ষণ পরপর কাচ ভাঙবে এমনই তো নিয়ম!

কিন্তু ওই কাচভাঙাটা বেশ খেয়াল করে লখিন্দর। বমির কথা ভুলে যায় সে। একটা মুচকি হাসি কি তখন তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে? এই এত আঁধার আর এত লালনীল আলোর ঝলকানিতে ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু মনে হয়, হাসি অথবা একটা কিছু, লখিন্দরের ঠোঁটে ফুটে ওঠে ঠিকই। তাতে, আমাদের চেনা পরিচিত লখিন্দরকে, ভয়ানক দেখায়। মনে হয় এ কোনো গ্রামীণ হিরো নয় বরং হলিউড সিনেমার ঠাণ্ডা মাথার ভিলেন। আর আমাদের তখন খুব আশ্চর্য লাগে। তাহলে নায়কও কখনো কখনো ভিলেন হয়ে উঠতে পারে? আমাদের খুব ঘোর লাগে, অস্থিরও লাগে-- আমরা সুবোধ নায়ক চাই, প্রতিবাদী নায়কও চাই, কিন্তু হ্যাপি এন্ডিং আমাদের দাবী। আর সেই হ্যাপি এন্ডিং-এ নায়ক যেন নায়ক থাকে। নায়ক যেন ভিলেন না হয়ে ওঠে। আমরা নায়ককে নায়ক হিশেবেই চাই, সবসময় চাই! দেখি লখিন্দর এগিয়ে যায় আমান খানের দিকে। হয়তো নায়ক বলেই যায়। একটু ধীর পায়ে। যেন সঞ্চিত শক্তিটা তেমনভাবে খরচ করতে চায় না। আমান খান তখনো ওই ভাঙা কাচ টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। সেগুলোর ওপর লখিন্দরের ছায়া পড়লে আমান খান মুখ তোলে। লখিন্দরকে দেখে তার ভ্রুয়ের মাঝে একটা দাগ তৈরি হয়। লখিন্দর বলে, আপনি ঠিক আছেন তো?

গালি দিতে চায় আমান খান। বলতে চায় শুয়োরের বাচ্চা আমি কেমন আছি তাতে তোর কি... কিন্তু আমান খান বলে না। আমান খান ভালো অভিনেতা বলেই না এই এতদিন ধরে সুপারস্টার। নিজেকে সামলে নিতে তাই তার সময় লাগে না। গালির বদলে লখিন্দরকে হাসি দেয় আমান খান। বলে, আমি ঠিক আছি। তবে তুমি ভালো থাইকো...

শেষের শব্দটা বলার সাথে সাথে পা চালায় আমান খান। বেরিয়ে যায়। টলমল নয়, একেবারে দাপুটে পায়ে। যেভাবে সে এতকাল এই ঢাকাই ফিল্মে চলেছে। খটখট আওয়াজ তুলে। লখিন্দর সে যাওয়াটা দেখে। নায়কের আসা আর যাওয়াটাই মুখ্য সিনেমায়-- এমনকি জীবনেও, লখিন্দর এমন ভাবে। এবং নিজেকে প্রশ্ন করে, বলে, তুমি কি আসতে পেরেছো এখনো? তোমার আসা কি হয়েছে? নাকি তুমি এখনো আসলে অপেক্ষা করছো সেই সত্যিকারের আসার... যে আসাটা ওই আমান খান অর্জন করেছে অনেক অনেক দিন আগেই!

লখিন্দর কোনো উত্তর পায় না ভেতর থেকে। ফলে ভেতরটাকে তার প্রতিপক্ষ মনে হয়। সে প্রতিপক্ষকে জ্বালিয়ে দিতে চেয়ে ঢক করে গেলে আরেক পেগ হুইস্কি। এবং লখিন্দর অপেক্ষা করে প্রতিপক্ষের। আর প্রতিপক্ষ কিছুক্ষণের ভেতরেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। লখিন্দর একবার ওয়াক করে শব্দ করে। তারপর হড়হড় করে করে বের করে দিতে থাকে অর্থহজম খাদ্য ও পানীয়। অচেনা শিরাউপশিরায় খাদ্য ঢুকে পড়ে। আমান খানের ভাঙা গ্লাশের ওপর লখিন্দর বমি করতে থাকে। লখিন্দরের মনে হয় সে মরে যাচ্ছে... আর এমন অনুভূতির ভেতর তার এই প্রথম মনে হয় সে আসলে খুলে খুলে যাচ্ছে। তার ভেতরের সমস্ত দরজা-জানালা-কপাট খুলে যাচ্ছে। লখিন্দর বমির শেষ বিন্দুটি উগড়ে দেয় মেঝেতে। তারপর পকেট হাতড়ে একটা সুগন্ধী রুমাল বের করে সে। সেটা দিয়ে মুখটা মোছে। রুমালটা তার খুব পরিচিত মনে হয়। রুমালের সুগন্ধ তার বমির দুর্গন্ধে ভরে যায়। লখিন্দর একবার হেসে ওঠে। তারপর নিজেকে সামলে নেয়। ফলে আমরা লখিন্দরের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাই। আর আমান খানের গাড়ির ব্যাকলাইট ধরে চলে যাই রঞ্জনার বিছানা পর্যন্ত। যা দেখার আমাদের অধিকার নেই তাই দেখি ফেলি তখন। যা শোনার আমাদের অধিকার নেই তাই শুনে ফেলি তখন। যা জানার আমাদের অধিকার নেই তাই জেনে ফেলি তখন।

কিন্তু আমাদের ভেতর কোনো অপরাধবোধের জন্ম হয় না। বরং মানুষ আর সভ্যতার অসীম দূরত্ব আরেকবারের মতো আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়।

(চলবে...)

ছবি: গুগল চিত্র

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন