সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

Man vs Eid

[ঈদের ছুটে চলে এসেছে। গরুর হাম্বা ডাকের সাথে অবধারিতভাবে চলে এসেছে গ্রামে যাবার দিন তারিখও। চলছে জোর প্রস্তুতি। ঢাকায় যারা থাকে তাদের জন্য ঈদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার এই প্রস্তুতিটা। কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
বেয়ার গ্রেইল আছে না! তার কথাবার্তা সব বাংলায় ডাবিং করে দেয়া হলো। সবাই তো আর আমার মতো ইংরেজিতে পাকা না!]

Man vs Eid


Ahmed Khan Hirok's photo.

হাই, আমি বেয়ার গ্রেইল। চড়েছি এভারেস্টের চূড়ায় আর ঘুরে বেরিয়েছি আমাজন জঙ্গলেও। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু ছুটে বেরিয়েছি সমানে। আমি জানি টিকে থাকতে চাইলে সবচেয়ে জরুরী হলো মানসিক শক্তি। আর এটা সবসময় কাজে দিয়ে এসেছে। কিন্তু আজকে আমি নিজেও একটু ভীত। কারণ আমার পেছনে দেখতে পাচ্ছেন লোকারণ্য এক দুর্গম ঢাকা। এরা সবাই নিজের নিজের গ্রামে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। আর আমাকে সেটি ঠেলে পৌঁছাতে হবে আমার গ্রামের বাড়িতে। ঈদের আগে আগে কাজটি সহজ নয়। কিন্তু বন্ধুরা, এটাই জীবন!

প্রথমেই আমি চেষ্টা করব ট্রেনে করে ফেরার। আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি কমলাপুর রেলস্টেশনে। কিন্তু আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন এত মানুষের ভিড়ে এতটুকু নড়ার ক্ষমতা পর্যন্ত আমার নেই। এই ভয়ঙ্কর চাপ আর গরমের মধ্যে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে কেউ যেন আপনার নাকের কাছে তার বগল না নিয়ে আসতে পারে। নাহলে হঠাৎ করেই আপনার অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেবে আর আপনি সঙ্গে সঙ্গে দম আটকে মারা যেতে পারেন। মানুষের এই চাপের ভেতর টিকে থাকার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো কেবল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা আর মাঝে মাঝে রুই মাছের মতো মুখ উঁচিয়ে হা করে শ্বাস নিতে থাকা। এতে আপনার রক্ত চলাচল ঠিক থাকবে, আর আপনার হার্ট কার্যক্ষম থাকবে।

বন্ধুরা, শুনতে পাচ্ছো? হ্যাঁ এটা একটা হুইসেলের শব্দ। নিশ্চয় ট্রেনের হুইসেল। ট্রেনের হুইসেল শুনলেই আপনি স্মৃতিকাতর হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু এখন তেমন সময় নয়। বরং এটা ঠিক যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। হুইসেলটা শুনতেই সবাই একসাথে নড়ে উঠল। ঝমঝম করে ট্রেন এগিয়ে আসছে। শব্দটা আমার কানে বৃষ্টির শব্দের মতো আনন্দদায়ক লাগছে। ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরছি এরচেয়ে মজার আর কীইবা হতে পারে!

এই ভিড়ভাট্টার ভেতর ট্রেনে উঠতে চাইলে আপনাকে প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো যে কোনো একটি বগির যে কোনো একটি দরজা বেছে নিতে হবে। আর সেই দরজার দিকে আপনার নাকটাকে কম্পাসের মতো স্থির রাখতে হবে। আর বিশ্বাস রাখতে হবে আপনার পেছনের লোকগুলোর ওপর। তারাই আপনাকে ধাক্কা দিতে দিতে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। এভাবেই বৈরী অবস্থাকে আপনার নিজের পক্ষে কাজে লাগাতে হবে। টিকে থাকার এটাই প্রধান উপায় এবং অনুপ্রেরণা!

ট্রেনটা চলে এসেছে। কিন্তু অবাক কাণ্ড! ট্রেনটা আগে থেকেই লোকে ঠাসা। একটা মানুষ দূরে থাক ওখানে একটা পিঁপড়া ঢোকারও জায়গা নেই। কিন্তু এর ভেতরেও অন্যরা উঠতে শুরু করেছে। আর টিকে থাকতে চাইলে আপনাকেও তাই করতে হবে। আপনি আপনার নাকটাকে স্থির করুন। আর বাছাই করা দরজার দিকে এগিয়ে যেতে থাকুন। কিন্তু হায় খোদা... পেছন থেকে লোকজনেরা ধাক্কা দিয়ে আমাকে অন্যদিকে সরিয়ে দিচ্ছে আর ওরা নিজেরাই উঠতে চাচ্ছে! ট্রেন ছুটে যাচ্ছে কিন্তু আমি হাতলটা ধরতে পারছি না! ওহ নাহ! ওহ! ট্রেন এগিয়ে গেল আর আমি পিছিয়ে গেলাম... আর শেষ পর্যন্ত ট্রেনটা মিস হয়ে গেল!

:::বিজ্ঞাপন বিরতি:::

জীবনে মাঝে মাঝেই এমন পরিস্থিতি আসতেই পারে। টিকে থাকা কখনোই সরল কোনো খেলা নয়। মাঝে মাঝেই ব্যর্থতা আপনাকে ভেঙে ফেলতে চাইবে। কিন্তু কোনোভাবেই নিজেকে হারতে দেয়া চলবে না। রেলপথে যেতে না পারলে আপনাকে তখন বিকল্প ভাবতে হবে। আর এ মুহূর্তে আমার সামনে বিকল্প হলো বাসভ্রমণ। আমি এখন একটা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। চারিদিকে ভারী ভারী লাগেজ আর গিজগিজ মানুষ। বাসভ্রমণের ভয়ানক দিক এই যে এখানে বিনা পয়সায় ভ্রমণ করা যায় না। এজন্য আমাকে টিকেট কাটতেই হবে। কিন্তু কাউন্টার বন্ধ। কোনো টিকেট নেই। সব টিকেট নাকি অনেক দিন আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। আমি কয়েকবার টিকেটের কথা বলতেই একজন আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে একপাশে, আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন। তার কথাবার্তায় আফ্রিকান চিতার মতো ধূর্ততা। এসব ধূর্ততাকে সামলেই আপনাকে পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে।

আফ্রিকান ধূর্ত চিতা তার টিকেটটা আমার কাছে বিক্রি করতে চাচ্ছে।

প্রতিকুল পরিস্থিতিতে কখনো কখনো প্রকৃতি নিজ উদ্যোগে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। তখন তা গ্রহণ করতে হয়। একটু বেশি টাকায় টিকেটটা কাটলেও কোনো আফসোস আমার নেই। কারণ এখন টিকেট পাওয়া মানে বিষয়টা সোনার হরিণ পাওয়ার মতোই দুর্লভ! জোড়াসাঁকোর কবি রবীন্দ্রনাথ সোনার হরিণ চাইতে গিয়ে গান লিখতে পারেন আর আমি কি বাড়তি ক'টা টাকা গুনতে পারি না?
বাসে ওঠার আগেই আমি লম্বা ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন হেডফোন আর স্মার্টফোনে পর্যাপ্ত চার্জ আছে কিনা সেটা দেখে নিই। এ দুটো ছাড়া কোনো লম্বা ভ্রমণ কখনোই আনন্দদায়ক হতে পারে না!

আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন বাসটা লম্বাটে আর ভেতরেও মানুষের সমাগম আছে। আমাকে এর মধ্যেই নিজের জায়গাটা করে নিতে হবে। আমার টিকেটে সিট নম্বর লেখা E3। আর এই যে এখানে E3। তবে এই সিটে আগে থেকেই একজন শুয়ে আছে। উনি হয়তো ভুল করে সিটটায় শুয়ে পড়েছেন।

: এই যে ভাই, হ্যালো, এই যে, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি!
: কী হইছে? ডাকেন ক্যান? দেখতেছেন না ঘুমাইতেছি!
: ভাই এটা আমার সিট... এই যে আমার টিকেট... E3!
: ওই রকম E3 আমার কাছেও আছে! এই যে... এইটা কাউন্টার থেকে কাটছি দশ দিন আগে! আপনে এই টিকেট কই পাইছেন? দালালের কাছে?

:::বিজ্ঞাপন বিরতি:::

আর কখনো কখনো আপনার সাথে এমন ঘটনা ঘটবে... যখন মনে হবে পুরো পৃথিবীটাই আপনার বিপক্ষে চলে গেছে। আর কোথাও থেকে আপনি কোনো সাহায্য পাচ্ছেন না। কিন্তু এর মধ্যেই আপনাকে টিকে থাকা শিখতে হবে। দেখতেই পাচ্ছেন আমাকে ছাড়াই বাসটা চলে যাচ্ছে। আমি নকল টিকেটটা ছুঁড়ে ফেলেছি রাস্তায়। কিন্তু আমি থেমে নেই। কারণ থেমে গেলে আপনি আর আপনার লক্ষে পৌঁছাতে পারবেন না। মানুষ অদম্য। কোনো কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারে না। আমি তাই হাঁটতে শুরু করেছি। আমার গন্তব্য অনেক দূর... কিন্তু আমি থেমে যেতে চাই না।
আর দেখুন ওই যে... ওখানে একটা খালি ট্রাক। ওটি গ্রামের দিকেই যাচ্ছে। শহরে ভারতীয় গরু পৌঁছে এখন ফিরে যাচ্ছে। আমার উচিত হবে আপনাদের সাথে কথা বন্ধ করে এক দৌড়ে ট্রাকের পেছনে ছুটে যাওয়া।

: এই যে... ও ভাই... ও ভাই ট্রাকচালক... হ্যালো... হেই... আমি... দাঁড়াও দাঁড়াও... আমাকে নিয়া যাও ভাই...!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন