শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

গল্পটি আপনারও হতে পারত


দেখতে না দেখতেই বাসটা যেন বাংলাদেশ হয়ে উঠল। এতে অবশ্য কারও আপত্তি নেই, থাকার কথাও নয়। লোক দেখে চোখ সয়ে গেছে আমাদের। বরং মানুষের ভিড় না দেখলেই ভয় পাই, কিছু হলোটলো নাকি, ছাত্র কিংবা শ্রমিক বা নেতা ধর্মঘট! আর ধর্মঘট হলেই তো, ব্যস, বাস ভাঙচুর। কার কী হবে, জানি না, নিজের জীবনটা নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি। তো, বসতে পেরেছি, এটা ভাগ্য; অনেক দুর্ভাগা দাঁড়িয়ে আছে, এ-ওর গায়ে ঠেস দিয়ে, ধাক্কা দিয়ে, আঁকড়ে ধরে। আমার ঘাড়ের ওপর একজন পশ্চাদ্দেশ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছেন, কিছু বলতেও পারছি না, সইতেও পারছি না—মাঝে দুবার গলা খাকারি দিলাম, কাজ হলো না। আমার পাশের আসনগুলো মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত, তা মহিলা মানে মেয়েরা বসেছেও ওই ছয়টা আসনে আটজন।
আমার ঘাড়ের ওপর যে ব্যক্তি, তাঁর প্যান্টের পকেটের পাশ দিয়ে ওই পাশের মেয়েটিকে দিব্যি দেখা যায়। সুদর্শনাই বলা যায়; লম্বা, ফরসা, তবে মুখের কাছে এসে হঠাৎ চেহারাটা কেমন বিষণ্ন হয়ে গেছে। বাস চলছে, ঝাঁকুনি-দুলুনি চলছে, আমার মনও চলছে—চলা মানে কল্পনার রং মাখানোই চলা। মেয়েটির কী সুন্দর হাত, হাতের নখে কী সুন্দর নেইলপলিশ! কিন্তু তার চেয়ে সুন্দর তার হাতের ওই মুঠোফোনটি...আহা! আমিও কদিন আগে একটা ফোন কিনেছি, তাই জানি ওই ফোনের তুলনায় আমারটা কিছুই না। দামি ব্র্যান্ডের কালো রঙের স্লাইড ফোন। আহা, ঠেলা দিলেই আলোকিত কি-বোর্ড বেরিয়ে আসে। দুবার রিং এল তাতে—কী মিষ্টি টোনে বেজে উঠল। মেয়েটা কেমন আলগোছে ফোনটা ধরে আছে। এক ঝটকায় টান দিলে যে কেউ—যে কেউ কেন, আমিই না কেন—নামার সময় একটু ধাক্কা দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে মহানগরের জনস্রোতে মিশে যাওয়া কঠিন কিছু তো না। ফার্মগেট-গুলিস্তানে এমন তো হরহামেশাই হচ্ছে। আমার এক বন্ধুর ফোন নাকি এভাবে গেছে। ফার্মগেটের তিন নম্বর গাড়িতে ঠেলাঠেলি করে যখন সে উঠছে, তখনই নাকি বুঝতে পারল তার পকেট থেকে কেউ ফোনটা নিয়ে নিল। কিন্তু হায়! জনসমুদ্র...তুমি কাকে কী বলবে? কাকে ধরবে? ব্যস,...শেষ, গল্পের ও ফোনের ইতি। বন্ধু বলেছিল, ‘ওঠার আর নামার সময় খুব সাবধান থাকবি, ওই সময়ই জিনিস নেওয়া সহজ।’ সহজ? কতটা সহজ? এই মেয়েটা নামবে, আমি তার পিছু পিছু যাব, তারপর বাস থেকে একেবারে নামার মুহূর্তে ছোট্ট একটা ধাক্কা দিয়ে হাতে আলগোছে রাখা ফোনটা নিয়ে ফুটে যাওয়া...এতটাই সহজ? তারপর লুকিয়ে যাওয়া, গা ঢাকা দেওয়া। ব্যস, কেল্লা ফতে! ফোনটা কোনো গলির ভেতর গিয়ে, চিপার ভেতর গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব অফ করে দিতে হবে—এসব আমার জানা। ব্যাটারি খুলে সিমটা ফেলে কদিনের জন্য ফোনে কোনো সিমই ঢোকালাম না;
তারপর একদিন নিজের নতুন একটা সিম ঢুকিয়ে ব্যবহার করতে লাগলাম আর বন্ধুবান্ধবকে বললাম আন্টি গিফট করেছে।
এখানে এসে আমার চিন্তায় একটু ব্যাঘাত ঘটল। বাসটাও তাদের এক কাউন্টারে দাঁড়িয়েছে; মেয়েটা নেমে যায় নাকি, কে জানে! নাহ্, কেউ তো নামলই না, বরং আরও গাদাগাদি ঠাসবুনটের বাস হয়ে দাঁড়াল এবং আমার জন্য আরও সুবিধাই হলো বলা যায়। ‘যত ভিড় তত মজা চুরির কামে’—কে যেন বলেছিল, ভুলে গিয়েছি। যা-ই হোক, ওই মুঠোফোনে নিজের সিম ঢোকানো বোধ হয় ঠিক হবে না, এখন নাকি গোয়েন্দা বিভাগ বা র‌্যাব খুব সহজেই চালু থাকা ফোন লোকেট করতে পারে। তাহলে, তাহলে বিক্রি; হ্যাঁ, এইটাই হবে একমাত্র সুব্যবস্থা! কোনো বন্ধুর বন্ধুর কাছে, কিংবা ও রকম কোনো দোকানে যারা সেকেন্ডহ্যান্ড ফোন কিনে নেয়; দাম অবশ্য একটু কমই পাওয়া যাবে, কিন্তু আমার নিজের ফোনটাও বিক্রি করে ওই মডেলের হ্যান্ডসেট দিব্যি পাওয়া যাবে। তাহলে বিক্রিই ঠিক! একটা ধাক্কা, অল্প একটু রিস্ক...অল্প একটু কি? রিস্ক কিন্তু ভালোই...মেয়েটা যদি চিৎকার করে ওঠে বা আমার হাতটাই খপ করে ধরে নেয়! আর চারদিকে যে মানুষ, পিটিয়ে হয়তো মেরেই ফেলবে; হয়তো পুলিশে দেবে, পত্রিকায় ছবিসহ নাম আসবে; সবাই দেখবে। আমার বুড়ো বাপটা তো হার্ট অ্যাটাকেই মারা যাবেন। আর আম্মা...তিনি তো রাত-দিন শুধু আমার গুণগান করেন এপাড়া-ওপাড়া—তিনি নিশ্চয় পাগল হয়ে যাবেন। আমার বন্ধুবান্ধবের কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না! আর নীলা...! ছি ছি...নীলা তো আমাকে বিশ্বাস করে ঈশ্বরের মতো! সে যখন জানবে, আমি একটা মুঠোফোন চুরি করতে গেছি...সে হয়তো ছাদ বেছে নেবে, কিংবা সিলিং...
কালো রঙের ফোন, স্লাইড, বোতামগুলো আভা ছড়ায়...আহা, হবে হবে...এর চেয়েও ভালো কোনো ফোন আমার হবে—হাতে নিয়ে ঘুরব। লোকজন দেখবে, আর কেউ কেউ হয়তো আমার মতোই ভাববে। হা হা হা...আমার গন্তব্যের কাউন্টার চলে এসেছে। আরও কয়েকজন নামছে, কয়েকজন উঠছেও, কে আগে নামবে, কে উঠবে—এ নিয়ে এন্তার হাঙ্গামা। ফোনটার দিকে আরেকবার তাকালাম। হবে, হবে। একেবারে পিঠের ওপর ধাক্কা দিয়ে মানুষ নামছে, আরে বাবা, আমিও তো নামব, তাই না! আহ্, দিল পা-টা মাড়িয়ে, স্যান্ডেলের এ অবস্থা নিয়ে নীলার কাছে যাওয়া যাবে? ওফ্, অবশেষে বাস থেকে নামা গেল। মনে হলো, একটা গেরিলা ট্রেনিং নিলাম। এবার নীলাকে ডাকতে হয়...দুজন মিলে আজ শুধু ঘোরাঘুরি...ডান পকেট থেকে মুঠোফোনটা বের করতে গিয়ে দেখি, নেই...এক দুই তিন চার...কোনো পকেটেই নেই। মানে! মানে, আমার মতো আরও কেউ ভাবে, তারপর ভাবনাটাকে কাজে লাগায়। নচ্ছাড়ের দল!


(প্রকাশ: ছুটির দিনে । তারিখ: ১৩-১১-২০১০)

ভালোবাসার খেত এখনো সবুজ


এখন আকাশ থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে আশা
সাদা কবুতরের মতো
একদিন তারা মাটিতেই ফিরে আসবে।

মাটিতে ভালোবাসার খেত এখনো সবুজ।

ফলেতিহাস

ফলত সফল ফল শুধুমাত্র আদমের গন্ধম
আর সব নিস্ফলা ফরমালিন, দামে বেশি কামে বড় কম ।

আত্মরতি

বৃষ্টি যখন পড়তেছিল আমি তখন ঘামতে ছিলাম
দেহের ভিতর হাজার সিঁড়ি- সিঁড়ি বেয়ে নামতে ছিলাম।
নামতে নামতে হাঁপাই গেলে ঢুকছি গিয়ে ভিতর-বাড়ি
অন্ধকারে ছাওয়া সবই এবং সে-সব ইতর ভারি-
যায় না দেখা মুখটা তাদের শরীর ভীষণ নুতপুতে
শরীর পেলেই চাগিয়ে ওঠে এক ঝটকে চায় শুতে!

ফলাফলে আবার সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নিচের দিকে
আপন পাপের আকর্ষণ বুঝতে থাকি পিছের দিকে-
নামতে আছি ঘামতে আছি পাপের ধাওয়ায় জুটছে ভুল
নামতে আছি ঘামতে আছি কামের হাওয়ায় ফুটছে ফুল ।

ইনসমনিয়া


তাহলে এটাই তোমার নিয়তি ছিল?

শেষ বারো মিনিটে ছয়বার কিংবা বারোবার ভাবলে তুমি। ভাবলে, কিন্তু ভাবনা তোমার ঠিক স্পষ্ট নয়। ঘোর অন্ধকারের মধ্যেও সময় স্পষ্ট নয়, রাত নাকি দিন? ভাবতে চাইলে, কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবতে পারলে না। পিঠের নিচে থকথকে কাদা, কোমরের কাছ থেকে শার্ট উঠে যাওয়ায় পিঠে সে কাদা ঠান্ডা অনুভূতি জাগাচ্ছিল। তুমি একবার শিউরে উঠলে। ঠান্ডায় না অন্যকিছুতে বোঝা গেল না। নরম কাদা পানির ভেতর তোমার ভয় লাগার কথা- কিন্তু তোমার মনে হচ্ছে তুমি পেলব কোনো বিছানায়, বড় আরামে এবং নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যাচ্ছ। মানে ঘুমাতে চাচ্ছ আর কি, তবে পারছ না। দীর্ঘদিন না ঘুমিয়ে কেবল শুয়ে থাকতে তোমার কোনো দিনও খারাপ লাগে নি; অতীতে তোমার এমন অবস্থা কেটেছে- তুমি মনে করতে তোমার ইনসমনিয়া আছে। পরে জেনেছিলে ওসব বাজে কথা! সুষ্ঠু পরিশ্রম হলে রাতে ঘুম হয়- তা বিছানা যেমনই হোক। অথচ তুমি এও মনে করতে যে তোমার বিছানা-বাতিক আছে। ছাত্রাবস্থায়, যখন বড় অসহায় দিনযাপন করছ, পকেটে টাকা নেই, পেটে ভাত নেই, পড়ায় মন নেই এমন অবস্থাতেও তুমি তোমার সিঙ্গেল বিছানাকে পরিপাটি করে রাখতে। বিছানার একমাত্র চাদরটা ঠিকঠাক পরিষ্কার রাখতে। ফ্লোরিং ব’লে বিছানায় খুব বালি হতো- তুমি তোমার সংগ্রহের সমস্ত বই তোষকের ধারে দিয়ে বিছানার কিনারার উচ্চতা বাড়াতে। সে বিছানায় শুয়ে তোমার মনে হতো পুনর্ভবার ডিঙিতে শুয়ে আছ। পুনর্ভবা, সেই আশ্চর্য নদী, যেখানে তোমার শৈশব ভেসে ভেসে রাঙা হয়ে উঠেছিল। সারাটি রাত তোমার ঘুম আসতো না, কিন্তু শুয়ে থাকতে তোমার ভালো লাগত। তোমার জীবনের একমাত্র বিলাসিতা ছিল পুনর্ভবার মতো তোমার বিছানাটি।
পরে অবশ্য সময়ের সাথে তার পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু কীভাবে যেন বিছানার একটা অংশ থেকেই যায়। মানুষের জীবনে বিছানা গুরুত্বপূর্ণ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ- তোমার অন্তত তাই মনে হয়।
কিন্তু এখন পেলব কোমল অত্যন্ত আরামদায়ক একটা বিছানায়, কিংবা নালার পাশে দীর্ঘ বর্ষায় পুকুরে পরিণত হওয়া কাদাপানির ভেতর শুয়ে শুয়ে তোমার ঘুমাতে ইচ্ছা করছে, অথচ ঘুমাতে পারছ না। অনেকদিন পর, অনেক অনেক দিন পর মনে হচ্ছে তোমার ইনসমনিয়া আছে। তুমি বোধহয় জন্মের পর ঘুমাতেই পারো নি। পয়ত্রিশ বছরের একটা জীবন তুমি বোধহয় না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছ। কীভাবে সম্ভব?

তুমি একজনকে চিনতে যে ঘুমাতো না। না রাতে ঘুমাতো না দিনে ঘুমাতো। তার নাম সুরেন বা সুরেশ বা নরেশ ছিল। মাথায় কী এক অপারেশন করার পর কোনো একটা ঝামেলা হয়েছিল। ঘুম সৃষ্টিকারী নিউরোন বা তেমন কিছু কাটা পড়ে গিয়েছিল। ফলে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সে ঘুমাত না। রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে সে ছাদে হাঁটত। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিছানায় শুয়ে থাকত। শুয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেলে আবার হাঁটতে বের হতো। কখনো ছাদে হাঁটত, কখনো বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুনর্ভবার ধারে চলে যেত। তার জীবন নিয়ে সবাই কষ্ট পেত, অন্তত কষ্ট যে পাচ্ছে এমন আচরণ করত; কিন্তু তাকে তোমার দিব্যি সুখী মনে হতো। তার সাথে কথা বলে তুমি জানতে পেরেছিলে প্রথম দিকে কষ্ট হলেও এখন তার অভ্যাস হয়ে গেছে। মানুষ অভ্যাসের দাস মাত্র।
অল্প বয়সেই তোমার ভেতরেও এটা পোক্ত হয়ে গিয়েছিল যে মানুষ সত্যিই অভ্যাসের দাস। মানুষের যা একবার অভ্যাস হয়ে যায় তা ছাড়তে ঝামেলা হয়।

তোমার শেষের অভ্যাসের কথাই ধরা যাক। মাত্র বছর দুয়েকের অভ্যাস। কিন্তু তোমার মনে হতো তুমি যদি এক সন্ধ্যা বারে না বসতে পারো তবে তোমার পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবে। না না, অভ্যাসটা মোটেও মদের না। সবার মতো যদিও তুমি তাই ভেবেছিলে প্রথমে। ফলে কয়েকটা বোতল কিনে বাসায় বসে খেয়ে দেখেছিলে। লাভ হয় নি। দামি মদ খেতে মনে হয়েছিল চিরতার পানি। হ্যাঁ, চিরতার পানির স্বাদ তোমার জানা আছে। তোমার বাবা খেত পেট পরিষ্কার রাখার জন্য; কেউ তা খেতে চাইতো না বলে তুমি খেতে আগ্রহ নিয়ে; এবং খেতে তোমার ভালো লাগত। তুমি দীর্ঘদিন চিরতার পানি খেয়েছিলে, তোমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। মানুষ অভ্যাসের দাস মাত্র।

তো ঘরে বসে গ্যালন গ্যালন মদ খেলেও যে তোমার নেশা হবে না এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলে। কিংবা নেশা হওয়ারও ঠিক দরকার নেই। বারের আবছালো, উচ্চস্বর, সিগারেটের কটুগন্ধ, বেয়ারার ফালি ফালি করে দেয়া কাচা পেপে ও ফানটা সবই তোমার ভালো লাগত। এসবের সাথে আর কিছুর তুলনা তুমি পাচ্ছিলে না। তোমার মনে হচ্ছিল এর আগে তুমি কেন বারে বসো নি। রোজই তো বারকে পাশে রেখে, ঝা চকচকে সাদা গাড়িটা নিয়ে, অফিস থেকে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে তুমি। হ্যাঁ, বেশ হঠাৎ করেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট আর একটা গাড়ির মালিক হয়ে যাও তুমি। পুনর্ভবা থেকে যমুনা পেরোতে তোমার পঁচিশটা বছর লেগেছিল, কিন্তু মেসবাড়ি থেকে নিজের গাড়ি বাড়িতে উঠতে তোমার পাঁচ বছরও সময় লাগে নি। তুমি পারদর্শী ছিলে তোষামদে এটা সত্য, কিন্তু তুমি দারুণ কর্মঠও ছিলে। দুটির সমন্বয় ও একজন দয়ালু বস মিলে তোমার উন্নতিটা এত দ্রুত হয়েছিল যে মাঝে মাঝে তোমারও অবাক লাগত; এবং তোমার উন্নতির কথা ঈর্ষার সাথে পুনর্ভবার পাশে উচ্চারিত হতো। ঈর্ষার শব্দগুলো এত ঝাঁঝালো ছিল যে তুমি ঠিক করেছিলে কোনোদিন আর গ্রামে ফিরবে না। কিন্তু নিয়তি বলেও তো একটা জিনিস থাকে। যে নিয়তিতে তুমি কোনোকালে বিশ্বাস রাখো নি, আজ সপ্তম বা ত্রয়োদশবারের মত তুমি তাকে স্মরণ করলে।
তাহলে এটাই তোমার নিয়তি ছিল?

সবকিছুই চলছিল দারুণ মসৃণভাবে। দশটা থেকে অফিসে বসে পাঁচটার মধ্যে সব কাজ গুটিয়ে নিয়ে ছয়টা নাগাদ বারে পৌঁছানো, তারপর সেখানে ঘন্টা দুয়েক বা তিনেক বা চারেক বা পাঁচেক। একমাত্র বারে গিয়ে তুমি অনিশ্চিত হয়ে পড়তে। কখন বসবে তোমার জানা ছিল, কখন উঠবে তোমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সেখানে তুমি অভ্যাসের দাস হয়ে যেতে, এবং যেতে পেরে তোমার খুব ভালো লাগত।

এই বার চিনিয়েছিল দস্তিগার। দস্তিগারের সাথে নতুন একটা ব্যবসা ফাঁদছিলে তুমি। ক্লাশমেট আর গ্লাসমেট কখনো ভোলা যায় না- বাবা বলতেন; দস্তিগারকে তুমি গ্লাসমেট বানাতে চেয়েছিলে। ফলে এক সন্ধ্যায় ডেকেছিলে নিজের সুউচ্চ অ্যাপার্টমেন্টে। দস্তিগার অ্যাপার্টমেন্টে কিছুক্ষণ ব’সে, মনে হয় হাঁপিয়ে উঠেই, বারে যাবার প্রস্তাব দিয়েছিল। তুমি, বার সম্পর্কে অজ্ঞ না হলেও, বার যে তোমার ভালো লাগে না ভিড়ের জন্য, তা জানিয়েছিলে।
দস্তিদার বলেছিল নতুন পয়সার লোকদের বিচ্ছিরি বার না, সে তোমাকে নিয়ে যাবে গ্র্যান্ড বারে; এবং সে বেরিয়ে পড়েছিল।

দস্তিগার এ কাজটা প্রায়ই করত। তুমি যে কেবল কয়টা পয়সা চোখে দেখছ তা বারবার জানিয়ে দিত। দস্তিগারের দাদা ধনী, দস্তিগারের বাবা ধনী, দস্তিগারের বউ ধনী এবং দস্তিগারও ধনী। অতএব সে যে তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করেই বেরিয়ে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কী! দস্তিগারের পিছু নিতে তুমি এতটুকু কার্পণ্য করো নি। দস্তিগারকে তোমার প্রয়োজন- তার অর্থ প্রয়োজন, তার সমর্থন প্রয়োজন। রঙের ব্যবসায় সে ঈশ্বরের কাছাকাছি, তুমি ঈশ্বরের সঙ্গে বারে গেলে। আর কী আশ্চর্য, বারটা তোমার ভালো লেগে গেল! ভালো যে লাগল তা দস্তিগারও বুঝল, এবং বুঝে তোমার প্রস্তাবে অনায়াসে রাজি হয়ে গেল। তোমার আরেকবারের মত মনে হলো এতিহ্যবাহী বড়লোকেরা দিলখোলা হয়। নাহলে তুমি তো জানো তোমার সাথে ব্যবসা করার ঠেকা দস্তিগারের ছিল না। দস্তিগারের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোলাগা তৈরি হতে বেশি সময় লাগল না। আর ভালো লাগল দস্তিগারের চেনানো বারকেও। আরো পরে, বার ও দস্তিগার, দুটোই তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, তাই না?

মানুষ অভ্যাসের দাস মাত্র।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তোমাদের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে যাকে এখনকার ভাষায় বলে ‘অস্থির’ তেমনই হয়ে যায়! দস্তিগার তোমার প্রায় দোস্তে পরিণত হয়। প্রায় এ জন্যই যে একটা নিরাপদ দূরত্ব তুমি তার সাথে বজায় রাখতে। দস্তিগার তোমার চেয়ে বয়সে বড় এটাই একমাত্র কারণ নয়- তার তো পয়তাল্লিশ; বোধহয়, সবচেয়ে বড় কারণটা ছিল, তার বৈভব তার ব্যক্তিত্ব। কিন্তু একরাতের পর আর সে দূরত্ব নিরাপদ থাকে না। না বয়স না বৈভব না ব্যক্তিত্ব তোমাদের মাঝখানে আসতে পারে। সব কিছু এক ফুৎকারে উড়ে যায়।
সে রাত্রে, বারে ঘন্টা দুয়েক কাটানোর পর, দস্তিগার বৃটেনের এক বোতলের কথা বলে; যা তার ঘরে, তোমার জন্যই নাকি অপেক্ষা করছে। সন্ধ্যার পর সাধারণত তোমার কোনো কাজ থাকে না। সেদিন ছিল। নতুন একটি মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছিল। তাকে নিয়ে লংড্রাইভে যাবে বলে ঠিক করেছিলে। যমুনা রিসোর্টে সব কিছু ঠিকঠাকও ছিল। কিন্তু দস্তিগারের প্রস্তাব উপেক্ষা করার ক্ষমতাও তো তোমার ছিল না। ফলে মেয়েটিকে মিটিঙের কথা বলে দস্তিগারের বাড়িতে তোমরা দুজন মিটিঙে বসো।

দস্তিগারের বাড়িটি একদা শহরের বাইরে ছিল। ক্রমবর্ধমান শহর এখন বাড়িটাকে গ্রাস করতে যাচ্ছে। তবু এখনো নির্জন শহরতলীর পরিবেশ বজায় আছে। তিনতলা বাড়ির তেতলায় দস্তিগার তার বউকে নিয়ে থাকে। মাঝতলায় তার বাবা। মা গত হয়েছে অনেক আগে। নিচতলা ছেড়ে দেয়া আছে চাকর-বাকরদের জন্য। দস্তিগারের গ্যারেজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাড়িগুলোর পাশে নিজের গাড়িটাকে ব্যক্তিত্বগত কারণে অসহায় মনে হয়; ঠিক যেমন দস্তিগারের সামনে তোমার নিজেকে মনে হয়।

তিনতলায় সোজা তোমরা লিকার রুমে গিয়ে ঢোকো। দস্তিগার অন্তত তাই বলে। সে জানায় তার প্রত্যেক আবাসস্থলে একটা করে লিকার রুম আছে। তুমি আর এটা জানতে চাও নি যে তার আসলে কয়টা আবাসস্থল। মাঝে মাঝে এসব প্রশ্ন তোমার কাছে খুব অর্থহীন মনে হয়, কিন্তু মাঝে মাঝে এ প্রশ্নগুলোই তোমাকে খোঁচাতে থাকে।

লিকার রুমে কোনো আসবাব নেই। ঘরের মাঝে একটা দামি কার্পেট পাতা। চারদিকে ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো কোলবালিশ। স্টাইলটা বাইজি ঘরের মত, তুমি ভেবেছিলে। একটা দেয়াল জুড়ে লম্বা একটা পেইন্টিং। পেইন্টিং-এ একটি শিশু উবুর হয়ে নগ্নাবস্থায় শুয়ে আছে। তার মাথার ওপর দিয়ে মেঘ উড়ে যাচ্ছে। মেঘগুলো এত স্পষ্ট যে তোমার মনে হয় তুমি ছুঁলেই তা পানি হয়ে গলে যাবে।

ঘরের বাইরে থেকে ক্রিস্টালের ডলফিন আকৃতির অ্যাশট্রে নিয়ে এসে তোমার দিকে এগিয়ে দেয় দস্তিগার। তুমি জানো দস্তিগার সিগারেট খায় না। তার মানে তোমাদের মতো অতিথিদের জন্যই এ অ্যাশট্রের ব্যবস্থা। অ্যাশট্রে দেখেই তোমার সিগারেটের তৃষ্ণা পায়- ফস করে একটা ধরিয়েও ফেলো। আর তখন প্রথমবারের মত দস্তিগারের বউকে দেখতে পাও তুমি। খুব হালকা রঙের গোলাপি শাড়ির রঙটা এমন যে দস্তিগারের বউয়ের শরীরের রঙ থেকে তা পৃথক করা মুস্কিল। আর এই রাত এগারটায় শ্যাম্পু করা চুল দেখে তুমি অবাক হয়েছিলে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা ভাবি ভাবি ব’লে, সিগারেট লুকিয়ে, দ্রুত দাঁড়িয়ে তুমি খুব অদ্ভুত একটা দৃশ্য তৈরি করে ফেলেছিলে। তা দেখে দস্তিগার খুব হেসেছিল। কান লাল করে তুমি বৃটেনের তৈরি রক্তে মন দিয়েছিলে। ভেবেছিলে তোমার যদি কখনো বউ হয় তবে তা অবশ্যই দস্তিগারের বউয়ের মতই হবে। ফুরফুরে, সুন্দর আর আবেদনী। পাঁচ মিনিটে দেখা একটা মানুষ, মেয়েমানুষ বলেই হয়তো, তোমার ভেতর বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। আরো দীর্ঘ সময়ই হয়তো ঘুরপাক খেত, কিন্তু তুমি দেখলে দস্তিগার তার কাপড়-চোপড় খুলতে শুরু করেছে। দস্তিগারের শরীরটা সুন্দর। ছিপছিপে লম্বা শরীর। তোমার থেকে অন্তত আধহাত লম্বা। শার্ট খোলার পর সে যখন বেল্ট খুলে প্যান্ট খুলতে শুরু করল তোমার কেন যেন হঠাৎই খারাপ লাগতে লাগল। দস্তিগারের সারা শরীর ফরসা, প্রায় টকটকে লাল; কিন্তু পায়ে বনমানুষের লোম। পাদুটো যেন দস্তিগারের না। অতিকায় আর্টপেপারে বনমানুষের পা এঁকে দস্তিগারের নিচে কেউ যেন এঁটে দিয়েছে। তোমার একটু হাসিই পেল। সাধারণত যা দেখা যায় না তাই আজ দেখতে পাচ্ছ- দস্তিগারের নেশা হয়েছে। তুমি আরেকটা চুমুক দিলে পাত্রে। ভাবি এসে অনেক আগেই চিংড়ি ভাজা দিয়ে গেছে, তুমি তাতে ঠোঁট ঠেকিয়ে একটু বিষম খেলে। দস্তিগার পরনের একমাত্র পোশাক, নেভি ব্লু আন্ডারওয়্যারটাও খুলে ফেলছে। বাদুরের মত কালো প্রত্যঙ্গটি একবার লাফিয়ে উঠল। তার কি এতই গরম লাগছে? অথচ ঘরে এসি চলছে।

বিষয়টা যে গরম ছিল না, অথচ গরমের ছিল তুমি যখন বুঝলে ততক্ষণে তুমিও নগ্ন। নিজস্ব পৌরুষ নিয়ে তোমার গর্ব ছিল কিছুটা, তবে দস্তিগারের সামনে ওটি কুঁকড়ে থাকল। যেভাবে তুমি নিজে থাকো সবসময়। একটা পুরো রাত দস্তিগার তোমাকে ওল্টালো-পাল্টালো, রক্তপাত ঘটল, আর ওয়াইনে সব ভেসে গেল- তুমি এতটুকু আওয়াজও করলে না, করতে পারলে না। ভোরে গাড়ি নিয়ে যখন তুমি বেরিয়ে যাচ্ছিলে, তিনতলার ঝুলবারান্দায় দেখলে, সাদা নাইটি পরে দস্তিগারের বউ- তোমার ভাবি, চিনামাটির মগে কফি বা চা বা অন্য কিছু খাচ্ছে। তুমি তার চোখে কিংবা আর কারো চোখে কিংবা নিজের চোখে চোখ রাখতে পারছিলে না।

তারপরে তো ব্যাপারটা নিয়মিত হয়ে যায়। দস্তিগারকে তুমি কোনোদিনই না বলতে পারো নি, এখনও পারো না। কিন্তু মনে মনে তুমি চাও তুমি যেন না বলতে পারো। অনেক প্রস্তুতি নিয়ে ঘর থেকে বের হও, মনে মনে কত কথা ঠিক করে রাখো, কিন্তু দস্তিগারকে দেখলে তোমার জিব নড়ে না, কথা সরে না। তুমি পুতুলের মতো হয়ে যাও। দস্তিগার যা বলে তুমি তাই করো বাধ্য ছেলের মতো। তোমার ব্যথা হয়; কিন্তু দস্তিগার যখন জিজ্ঞেস করে ব্যথা হচ্ছে কি না, তুমি কিছুই উত্তর দিতে পারো না। তোমাকে সামনে নিয়ে দস্তিগার যখন প্রশ্ন করে প্রসাবের গন্ধ আছে কি না, তুমি তখন ¯্রফে মাথা নাড়াতে পারো। দস্তিগার তাতে খুশি হয় নাকি অখুশি হয় তুমি বুঝতে পারো না; এবং তুমি হয়তো এসব বোঝাবুঝির ভেতরে থাকতেই চাও না। তুমি বদলে যেতে থাকো। প্রিয় বার প্রিয় অফিস প্রিয় মুখ কিছুই তোমাকে সুখ দেয় না। টাকা তোমাকে সুখি করতে পারে না, তোমার ইনসমনিয়া ফিরে আসে। তুমি রাতের পর রাত ঘুমাতে পারো না। যে-মেয়েটি তোমার কাছে আসতে চাচ্ছিল, বা যে-মেয়েটির কাছে তুমি যেতে চাচ্ছিলে; যার জন্য যমুনা রিসোর্ট অপেক্ষা করছিল, তাকে তোমার ডাইনি মনে হতে থাকে। তাকে দেখলেই তোমার নিজের পুরুষাঙ্গের কথা মনে পড়ে। যেটিকে নিয়ে আজকাল তোমার লজ্জা হয়, ঘৃণা বোধ হয়।

ফলে তুমি চেষ্টা করো ব্যাপারটি উপভোগের। এতে উপভোগ নিশ্চয়ই আছে। অনেকেই করে। কিন্তু শত চেষ্টাতেও তুমি ঘটনাগুলো উপভোগ করতে পারো না। তোমার কাছে ব্যথা আর কষ্টই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা হলেই তুমি হিম হয়ে যাও। তোমার গলা শুকিয়ে যায়। কপালে ঘাম জমে। ডেস্কফোন বা সেলফোন সব বন্ধ করে দিতে ইচ্ছা করে; কিন্তু করতে পারো না। আর অবধারিতভাবে কলটা আসে- কি জাফর সাহেব, যাবেন নাকি?

তুমি যাও, তোমাকে যেতে হয়। না গিয়ে কি তোমার অন্য উপায় নেই? আছে নিশ্চয়। অন্য উপায় আছে নিশ্চয়। কিন্তু  তোমাকে যেতেই হয়। যেন এক অন্ধ চক্রের ভেতর রয়েছ তুমি। যা ঘটছে সব পূর্ব নির্ধারিত। যা ঘটবে তাও পূর্ব নির্ধারিত। যেতে যেতে যেতে তোমার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। আর মানুষ অভ্যাসের দাস মাত্র।
খেতে খেতে তোমার সিগারেটে মদে অভ্যাস হয়ে গেছে; সে অভ্যাসগুলো তুমি কখনো ছাড়াতে চাও নি। বরং মনে হয়েছে অভ্যাসগুলো হোক না খারাপ, তবু থাক। কিন্তু এই অভ্যাস, এই অনিবার্য আহ্বানকে তুমি কীভাবে ছাড়াবে? ছাড়াতে পারবে কি? তোমার মনে হয় তুমি কোনো দিনও বোধহয় আর স্বাভাবিক হতে পারবে না। তুমি নিশিগ্রস্ত চন্দ্রগ্রস্ত দস্তিগারগ্রস্ত।

একরাত্রে, উবুর হয়ে থাকতে থাকতে, পাশের ঘরে আলস্যে টিভি দেখা দস্তিগারের বউয়ের কথা তোমার মনে হয়। মনে হয়ে তোমার মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়। অনেক অনেক দিন পর তোমার উত্থান অনুভব করতে পারো তুমি। যা দেখে দস্তিগারও খুশি হয়। সে ভাবে তার সঙ্গ তুমি উপভোগ করতে শুরু করেছ। ফলে তার আরো কাম আসে। সে আরো শিৎকার করে। তুমি নিশ্চিত এসব আওয়াজ টিভির মৃদু শব্দ ছাপিয়ে দস্তিগারের বউয়ের কাছে পৌঁছায়; এবং পৌঁছায় ভেবে নিজের ভেতর ক্রোধ অনুভব করতে থাকো। কাম ক্রোধ উত্তেজনা সব মিলিয়ে এক উন্মাতাল অবস্থায় চিন্তাটা প্রথম তোমার মাথায় আসে। চিন্তাটা কিছুক্ষণ ঘুরপাক খায়। হ্যাঁ, এটাই হবে তোমার আবার বেঁচে উঠবার, নিজেকে ফিরে পাবার রাস্তা। নরকের দ্বার হবে তোমার জন্য পরিত্রাণের সড়ক।
আবার বদলে যাও তুমি, এবার স্বেচ্ছায়। তোমার মনে হতে থাকে গোপন কোনো মিশনে রয়েছ তুমি। নাইন-টেনে বিস্তর মাসুদ রানা পড়েছিলে; নিজেকে তোমার মাসুদ রানা মনে হতে থাকে। মনে হয় একটা তীব্র তীক্ষ্ণ জীবন-সংহারী মিশনে তুমি এক নির্বাচিত এজেন্ট। তুমি ধীরে ধীরে এগুতে থাকো। দিনের পর দিন কেটে যায়। দস্তিগারের বাড়িতে তুমি অপরিহার্য হয়ে ওঠো, এমনকি দস্তিগার না থাকলেও। প্রায় রাত্রেই দস্তিগারের সাথে ঘুমাতে হয় তোমাকে; তবে এ বিষয় নিয়ে বাড়ির অন্য সদস্যদের কোনো গরজ আছে বলে তোমার মনে হয় না। আর যে রাতে দস্তিগার আসে না, চলে যায় অন্য কোথাও অন্য কারো কাছে অন্য কোনো বৃটেনে, সে রাত্রে দস্তিগারের বাবার সাথে তোমার কিছুক্ষণ আলাপ হয়। আর অনেকক্ষণ আলাপ হয় দস্তিগারের বউয়ের সাথে; তোমার প্রিয় ভাবির সাথে। তোমার ভাবি প্রথম দিকে তোমাকে ঘৃণা করতো বলেই তোমার মনে হয়; তবে এখন বোধহয় করুণাও করে। এবং কখনো কখনো হাসাহাসিও করে। সেদিন যেমন বলেছিল, সোফায় তুমি এখনো বসতে পারো? কষ্ট হলে যাও বিছানায় শুয়ে পড়ো!
দস্তিগারের বাবাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কাশতে কাশতে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। আর তুমি বোকার মত লজ্জায় লাল হতে হতে সোফায় বসে থাকো। অথচ তোমার কী একটা জীবন ছিল, কী সম্ভাবনাময় জীবন ছিল, কী ঈর্ষণীয় জীবন ছিল!
চাইলে তুমি প্রতিবাদ করতে পারতে। বউয়ের থেকে দস্তিগারের কাছে তুমি কম প্রিয় ছিলে না। সে খাতিরে প্রতিবাদ করা তোমার জন্য কঠিন ছিল না; কিন্তু তুমি তো মাসুদ রানা- তুমি উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিলে। আর উপযুক্ত সময়, তোমাকে খুশি ক’রে, আসে শীঘ্রই।

দস্তিগারের বাবা এক দিনের জন্য শহরের বাইরে গিয়ে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কথা ভেবে আর ফিরলেন না। এদিকে শহরের বাইরে আটকে গেছে দস্তিগারও। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়েছে ঝড় আর বৃষ্টি। তুমি ভাবলে, তোমার জন্য এ এক নির্বাচিত দিন। কারেন্ট চলে গেলেও দস্তিগারদের নিজস্ব পাওয়ার সাপ্লাই আছে। সেটি চলছে। বাকি রাতে আর কারেন্ট আসবে কিনা সে সন্দেহে পাওয়ার সাপ্লাই চলছে শুধুমাত্র তেতলায়। ফলে চাকর বাকরেরা কী করবে গতি না পেলে দস্তিগারের বউ ওদের খেয়ে দেয়ে শুয়ে যেতে বলে। তুমি আর দস্তিগারের বউ তেতালার ঝুল বারান্দায় দাঁড়াও। এ রাত্রে, ক্রমাগত ঝড় আর ঘন বৃষ্টির রাত্রে, এই যে দস্তিগারের বউ তোমার সাথে ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে এতে কোনো রোমান্টিকতা নেই, তুমি জানো। কারণ দস্তিগারের বউ তোমাকে পুরুষই ভাবে না। বোধহয় নারীই ভাবে, কিংবা হিজড়া। এই ঝড়ের মধ্যে, ক্রমাগত ঝড়ের মধ্যে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তোমার মনে হলো তুমি ধীরে ধীরে মাসুদ রানা হয়ে উঠছো। তোমার মনে পড়ে যাচ্ছে কী তোমার কর্তব্য। দস্তিগারকে তুমি কীভাবে হারাবে, এই অন্ধ চক্রের ভেতর থেকে কীভাবে তুমি মুক্তি পাবে, তুমি তা জানো। তোমার মুক্তি, তোমার পরিত্রাণ লালচে নাইটি পরে ঝুল বারান্দায় দুহাত প্রসারিত করে পুরো শরীরে বৃষ্টি মাখছে। তুমি জানো তুমি তাকে আজ খুবলে নেবে। এই একটি দিনের কথা ভেবে, এই একটি রাতের কথা ভেবে, তুমি রাতের পর রাত জেগে থেকেছ; পোশাকের নিচে দড়ি নিয়ে ঘুরেছ। সেই দড়ি আজ কাজে আসবে। তুমি তোমার পকেটের ভেতর হাত চালাও; দড়িটা সেখানেই আছে। দড়ি দিয়ে হাত বাঁধবে, আর ব্রা দিয়ে মুখ বেঁধে ফেলবে। ব্রাটা এখনই দেখতে পাচ্ছ তুমি। রাঙা সাপের মত লাল ফিতা অল্প একটু বেরিয়ে আছে। কাঁধের গোলাপি মাংস কামড়ে ধরে খিলখিল করে হাসছে। তুমি দড়িটা বের করে ফেলেছ। ঝুলবারান্দা বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে। বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজে কান পাতা দায়। মাঝে মাঝে বিজলিও চমকাচ্ছে। তুমি মনে মনে বললে, নির্ধারিত রাত। দস্তিগারের ওপরে ঝান্ডা পোঁতার আজ পূর্ব নির্ধারিত রাত।
তুমি এবার ঝাঁপিয়ে পড়ো দস্তিগারের বউয়ের ওপর। প্রথমেই দড়িটা দিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে ওর হাত দুটো। পেছন করে বাঁধতে পারলে সবচেয়ে ভালো। তারপর মুখে...

কিন্তু কোনো বাধা নেই কেন? প্রতিহত করার স্পৃহা নেই কেন? কেন দস্তিগারের বউ তোমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে না? কেন কামড়ে দিচ্ছে না? কেন আঁচড়ে দিচ্ছে না? কেন চোখের মধ্যে নাকের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দিচ্ছে না?
তুমি দস্তিগারের বউয়ের দিকে তাকাও। দীর্ঘক্ষণ বৃষ্টিতে ভেজার জন্য কিংবা অন্য কোনো কারণে থরোথরো কাঁপছে তার হাত, কোমর, বুক, ঠোঁট। কিন্তু চোখ? চোখ সাদা। একদম সাদা। ভাষাহীন সাদা, অর্থহীন সাদা। এই সাদা তুমি আগে কখনো দেখ নি। নাকি অনেক অনেক আগে দেখেছ? বিদ্যুতের ঝলকানির সাথে সাথে তুমি যেন বজ্রাহত হয়ে ছেড়ে দিলে দস্তিগারের বউকে। কী দেখলে তুমি? কী দেখলে যে ছুটে বেরিয়ে গেলে ঝুলবারান্দা থেকে? কী দেখলে যে তোমার পৃথিবী হঠাৎ ঘুরে গেল, আবার বদলে গেল! যার জন্য তুমি তৈরি হচ্ছিলে ধীরে ধীরে, তিলে তিলে, যার জন্য জীবনের সবকিছু বাজি রেখেছিলে; কী দেখলে যে সব পাল্টে গেল? বিদ্যুতের আলোয় এ মধ্যরাতে কোনো পরী বা পেত্নি দেখলেও কি তুমি এতো চমকাতে?

লিফটকে পাশে রেখে সিঁড়ি দিয়ে ধুমধাম আওয়াজ তুলতে তুলতে তুমি যখন নিচে নেমে এলে, দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্যক্রমে দেখলে দস্তিগারের গাড়িটা গ্যারেজে ঢুকছে। গাড়ির মসৃণ শরীর থেকে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু পানির ওই বিন্দুগুলোকে তোমার মনে হয় দস্তিগারের বীর্য। মনে হয় শত শত গ্যালন বীর্য গাড়ি থেকে গড়িয়ে মেঝে, মেঝে থেকে পুরো গ্যারেজ, গ্যারেজ থেকে পুরো শহর, শহর থেকে থেকে পুরো পৃথিবী ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কারো নিস্তার নাই, কোনো কিছুর নিস্তার নাই।
দস্তিগার বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। তোমাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো, জিজ্ঞেস করতে চাইল এতো রাতে কোথায় যাচ্ছ... কিন্তু তুমি সে সবের সুযোগ দিলে না। গ্যারেজের মেঝেতে পড়ে থাকা চিকন নিষ্পাপ একটা রড উঠিয়ে আমূল গেঁথে দিলে দস্তিগারের পেটে। ভুস ধরনের একটা শব্দ হলো। রডটা একবার টেনে বের করতেই নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এলো কিছুটা; সাথে খাদ্য সাথে পানীয়। নিশ্চয় বৃটেনের দামী কোনো পানীয়। ভীষণ হাসতে ইচ্ছা করল তোমার। অনেকদিন পর হাসতে ইচ্ছা করল তোমার। কিন্তু হাসার আগেই গরম শিসার ছ্যাঁকা অনুভব করলে পিঠে। তারপর আবার করলে। পিঠের নিচ থেকে পেটটা পর্যন্ত যেন জ্বলে পুড়ে গেল। মনে হলো জ্বলন্ত লাকড়ি কেউ তোমার পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে। তুমি পেছন ফিরে তাকালে। দেখলে লালচে নাইটি পরে পিস্তল হাতে কবেকার মরে যাওয়া তোমার মা দাঁড়িয়ে আছে। এইবারে হাসলে তুমি। হাসতে গিয়ে মুখ বাঁকিয়ে গেল তোমার, জিব আড়ষ্ট হয়ে গেল এক দিকে। দারোয়ানটা ছুটে আসছে নাকি তুমি ছুটে যাচ্ছ দারোয়ানের দিকে? তোমার পা টলে উঠল। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন ঠিক বেরিয়ে এলে গেট থেকে।

বাইরে অন্ধকার রাস্তা। কোন দিকে ছুটে চলেছ তুমি জানো না। ঢালু পথ চেনা যাচ্ছে না আবর্জনা আর পানির ঢলে। একটা নালার পাশে গিয়ে পড়লে তুমি। কাদার ভেতর যেন ডুবে যেতে থাকলে। একবার বিদ্যুৎ চমকালো। রক্তে ভেসে যাওয়া পেটটা দেখলে তুমি। পিঠ দিয়ে ঢুকে পেটে ইদুরের মতো গর্ত করে বেরিয়ে গেছে বুলেট। নরম ঠান্ডা কাদা পিঠে কোমল বিছানার মতো ডুবিয়ে নিচ্ছিল তোমাকে। তুমি কি ঘুমিয়ে গেলে এর মধ্যে? না। অনেককাল তুমি ঘুমাও নি। তুমি ভেবেছিলে তোমার ইনসমনিয়া আছে। তবে আজ নিশ্চিত ঘুমাবে। শরীরটা হাঁচড়ে-পাচড়ে কাদা থেকে তুলে আরেকটু সামনে, নালার মধ্যে নেয়ার চেষ্টা করলে তুমি। নালা দিয়ে ঝর্ণার গতিতে বর্ষার ঢল বয়ে যাচ্ছে। এই ঢল, তুমি জানো, যমুনায় যাবে। আর একবার যমুনায় গেলে যমুনার স্রোত তোমার সাথে বেঈমানি করবে না। তোমাকে ঠিক ঠিক নিয়ে যাবে পুনর্ভবায়। পুনর্ভবায় ইনসমনিয়া নেই; পুনর্ভবায় শৈশবের ঘুম আছে।
পঙ্গু কুকুরের মতো লেংচিয়ে নিজের শরীরটা ভাসিয়ে দিলে বর্ষার ঢলে। তারপর হাসতে হাসতে ভাবলে, আহা এটাই তোমার নিয়তি ছিল!


প্রকাশ: নতুন ধারা ।৪৭ নং সংখ্যা।

আহমেদ খান হীরক এর খাটো গল্প


(খাটো গল্প অণুগল্প বলে বাজারে চালু যে-গল্প আছে তারচেয়েও ছোট। নাম পরমাণু গল্পই হওয়া উচিত। কিন্তু মনে হলো খাটো গল্পই হোক। মাত্র কয়েকটা লাইনে একটা গল্প বলার চেষ্টা। চেষ্টাটা এই নোটে ধারাবাহিকভাবে করা হবে।)

গল্প-০১
::সময়::

এক.
পাঁচ বছরী পারুল বাসে চিরকুট ফেরি ক'রে ভিক্ষা করে ।
পঁচিশ বছরী পারভেজ চিরকুট জানালা দিয়ে উড়িয়ে দেয় । একটি টাকাও সে দেবে না ।

দুই.
দশ বছর পর পারভেজ টাকা নিয়ে অপেক্ষা পারুলের দরজার বাইরে । রোজ রাতে ।
তারা কেউ কাউকে চেনে না।



গল্প-০২
::ছোটকুর ঈদ::

কাল ঈদ। ছোটকু খুব খুশি। গোসতো আর পোলাও রান্না হবে পাশের বাড়িতে।


গল্প-০৩
::এক চানরাতে::

ঢাকায় বেনামী লাশ।ভিক্ষার খুচরা টাকা পয়সা রাস্তায় ছড়ানো। ফুলতলি গ্রামের এক ঘরে অপেক্ষার চানরাত।


খাটো গল্প-০৪

শব্দ । মাথার ওপর উড়ে যাচ্ছে পাশ্চাত্যের বিমান ।
নীলাদের বাড়ি আর যাওয়া হবে না ।


খাটো গল্প-০৫

সংসার.

একটা অর্ধনীল মাছি উড়তেছিল ঘুরতেছিল । ময়রার বেঞ্চে একফোটা মিষ্টির রস । মাছিটা মিষ্টি রসে আটকে গেল ।


খাটো গল্প-০৬

একটি ভূতের গল্প

সতের দিন আগে একটি পাঁচ টনী ট্রাক আমার ওপর দিয়ে চলে যায় ।

রাজার হাসি

রাজার মুখে হাসি নেই। রাণী আর মন্ত্রীর দুঃশ্চিন্তার অন্ত নেই। রাজ্যজুড়ে মোবাইলে এসএমএস করে জানিয়ে দেয়া হল রাজার মুখে যে হাসি ফোটাতে পারবে তাকে দেয়া হবে সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা। 


বিরস মুখে দরবারে বসে আছেন রাজা। সঙ্গে আছেন রাণী, আরো আছেন মন্ত্রী। রাজাকে হাসাতে এল বদলপুরের বাঘের বাচ্চা। লম্বা শরীরে একটা মুখোশ আর একটা লেজ বেঁধে এসেছে সে। রাজা জিগ্যেস করলেন, কী নাম তোমার? 
- বাঘের বাচ্চা। 
- কী করবে? 
- আপনাকে হাসাবো রাজামশাই।- না হাসাতে পারলে গর্দান যাবে! 

বাঘের বাচ্চা শুরু করল নাচতে। তার নাচে দরবার কেঁপে উঠল। আকাশ নেমে এল। গরগর করে মেঘ ডাকল। শেষের দিকে একটু বৃষ্টিও হল- কিন্তু রাজা যেমন ছিলেন তেমনি বাঁকা হয়ে সিংহাসনে বসে রইলেন। একটা পেয়াদা এসে বাঘের বাচ্চাকে ধরে নিয়ে গেল। রাজা হাই তুললেন। রাণী হাই তুললেন। মন্ত্রীও হাই তুললেন। 
রাজা বললেন, বাজে নাচ। 
রাণী বললেন, বিচ্ছিরি নাচ।মন্ত্রী বললেন, জঘন্য নাচ। দেখা যায় না। 

এল আরেকজন। পরনে সাদাসিদা পোশাক। রাজা জিগ্যেস করলেন, কী নাম হে তোমার? 
- আজ্ঞে রাজামশাই, কোকিল। 
রাজা বললেন, কী বিদঘুটে নাম! কোকিল একটা বেহুদা পাখি- তার নামে নাম রাখতে হবে কেন? 
রাণী বললেন, কী যে বাজে নাম। এমন নাম বাপেরকালেও শুনিনি! মন্ত্রী বললেন, খুব বাজে নাম। নাম বদলে দিতে হবে। আজ থেকে তোমার নাম চিংড়ি, বুঝলা? 

কোকিল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। রাজা বললেন, তা তুমি কী করবে? নাচবে না কুতবে? 
- গান করব রাজামশাই।- তা বেশ। গাও। 

কোকিল গান ধরল। সূর্য হাসল গানে। চাঁদমামাও উঁকি দিয়ে দিয়ে হাসল ফিচকি ফিচকি। ফুল হাসল। বাতাস ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। শুধু রাজা গান শুনতে শুনতে সিংহাসনেই ঘুমিয়ে গেলেন, নাক ডাকাতে লাগলেন। কোকিল হঠাৎ একটা সুর ধরল জোরে- অমনি রাজার ঘুম গেল ভেঙে। কাচা ঘুম ভেঙে রাজা হলেন ব্যাজার। সুরুৎ করে মুখের লালা টেনে বললেন, কে রে? কে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিল অ্যা? 
রাণী বললেন, দাদারকালেও এত বেসুরো গান শুনিনি...! 
মন্ত্রী বললেন, খুব কুৎসিত সুর! এই কোকিলের বোবা হওয়াই ভালো, এই কে আছিস, ওর জিবটা কেটে দে!পেয়াদা এসে কোকিলকে ধরে নিয়ে গেল। 

রাজার মেজাজ খারাপ। এমন সময় ডাক পড়ল আরেকজনের। পেয়াদা ডাকল, সংপুরের বজ্জাত এসে হাজির হও... 
আর সঙ্গে সঙ্গে চোঙার মতো টুপি পরে, ঢোলাঢালা রঙচঙে আলখেল্লা পরে এল একজন। বাঁকা নাক, লম্বাটে থুতনি। এসেই মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, রাজার জয় হোক, রাজার জয় হোক। 
শুনে রাজা কিন্তু খুশি। বললেন, তুমিই বজ্জাত? 
বজ্জাত বলল, জ্বি রাজামশাই! 
রাজা বললেন, বাহ্ কী খাসা নাম... অসাধারণ, অসাধারণ!! 
রাণী বললেন, মিষ্টি একটা নাম!মন্ত্রী বললেন, চমৎকার নাম... এমন নাম সচরাচর শোনা যায় না! 

বজ্জাত মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসল। রাজা জিগ্যেস করলেন, তা তুমি কী করবে? নাচন-কুদন, নাকি গান? 
বজ্জাত বলল, না না রাজা মশাই ওসব ফালতু জিনিস... 
রাজা বললেন, ঠিক বলেছ, ওসব খুবই ফালতু জিনিস... বিশ্রী জিনিস! তো তুমি কী করবে তাহলে? 
বজ্জাত বলল, আপনাকে হাসাবো মহাশয়! 
মন্ত্রী বললেন, না হাসাতে পারলে কিন্তু গর্দান যাবে মনে রেখ। 
বজ্জাত বলল, আর হাসাতে পারলে স্বর্ণমুদ্রা মহোদয়, ওটাও মনে রাখবেন।রাজা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ শুরু কর তাড়াতাড়ি। 

বজ্জাত অমনি তার আলখেল্লার পকেট থেকে বের করল লম্বা লম্বা দুটো পালক। তারপর এক লাফে চলে গেল সিংহাসনের সামনে। রাজার দিকে ঝুঁকে পালক দিয়ে রাজার গলায়, বগলে, পেটে দিতে লাগল সুড়সুড়ি। রাজা প্রথমে মুচকি মুচকি হাসলেন, তারপর হাসলেন ফিকফিক করে, তারপরে হাসলেন হো হো করে। হাসতে হাসতে রাজার চোখের পানি নাকের পানি একাকার। রাজার সঙ্গে রাণী হাসলেন, মন্ত্রী হাসলেন।রাজা হাসতে হাসতে শুয়ে পড়লেন, তারপর হঠাৎ লাফিয়ে সিংহাসনে দাঁড়িয়ে গেলেন, হাত-পা ছুঁড়তে লাগলেন। সবাই বজ্জাতকে ধন্য ধন্য বলতে লাগল। রাজা হাসতে হাসতে কোনোমতে বললেন, এই বজ্জাতকে মুদ্রা দাও-টাকা দাও, ঘোড়া দাও-গাড়ি দাও, বাড়ি দাও-ব্রিজ দাও... নইলে আমাকে মেরেই ফেলবে হাসিয়ে... 
এরপর থেকে বজ্জাতের কিছু প্রয়োজন হলেই পালক নিয়ে সে রাজদরবারে হাজির হয়ে যেত। 


নীতিকথা- সুড়সুড়ি ছাড়া রাজাদের আনন্দ দেয়া যায় না।