শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

গল্পটি আপনারও হতে পারত


দেখতে না দেখতেই বাসটা যেন বাংলাদেশ হয়ে উঠল। এতে অবশ্য কারও আপত্তি নেই, থাকার কথাও নয়। লোক দেখে চোখ সয়ে গেছে আমাদের। বরং মানুষের ভিড় না দেখলেই ভয় পাই, কিছু হলোটলো নাকি, ছাত্র কিংবা শ্রমিক বা নেতা ধর্মঘট! আর ধর্মঘট হলেই তো, ব্যস, বাস ভাঙচুর। কার কী হবে, জানি না, নিজের জীবনটা নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি। তো, বসতে পেরেছি, এটা ভাগ্য; অনেক দুর্ভাগা দাঁড়িয়ে আছে, এ-ওর গায়ে ঠেস দিয়ে, ধাক্কা দিয়ে, আঁকড়ে ধরে। আমার ঘাড়ের ওপর একজন পশ্চাদ্দেশ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছেন, কিছু বলতেও পারছি না, সইতেও পারছি না—মাঝে দুবার গলা খাকারি দিলাম, কাজ হলো না। আমার পাশের আসনগুলো মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত, তা মহিলা মানে মেয়েরা বসেছেও ওই ছয়টা আসনে আটজন।
আমার ঘাড়ের ওপর যে ব্যক্তি, তাঁর প্যান্টের পকেটের পাশ দিয়ে ওই পাশের মেয়েটিকে দিব্যি দেখা যায়। সুদর্শনাই বলা যায়; লম্বা, ফরসা, তবে মুখের কাছে এসে হঠাৎ চেহারাটা কেমন বিষণ্ন হয়ে গেছে। বাস চলছে, ঝাঁকুনি-দুলুনি চলছে, আমার মনও চলছে—চলা মানে কল্পনার রং মাখানোই চলা। মেয়েটির কী সুন্দর হাত, হাতের নখে কী সুন্দর নেইলপলিশ! কিন্তু তার চেয়ে সুন্দর তার হাতের ওই মুঠোফোনটি...আহা! আমিও কদিন আগে একটা ফোন কিনেছি, তাই জানি ওই ফোনের তুলনায় আমারটা কিছুই না। দামি ব্র্যান্ডের কালো রঙের স্লাইড ফোন। আহা, ঠেলা দিলেই আলোকিত কি-বোর্ড বেরিয়ে আসে। দুবার রিং এল তাতে—কী মিষ্টি টোনে বেজে উঠল। মেয়েটা কেমন আলগোছে ফোনটা ধরে আছে। এক ঝটকায় টান দিলে যে কেউ—যে কেউ কেন, আমিই না কেন—নামার সময় একটু ধাক্কা দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে মহানগরের জনস্রোতে মিশে যাওয়া কঠিন কিছু তো না। ফার্মগেট-গুলিস্তানে এমন তো হরহামেশাই হচ্ছে। আমার এক বন্ধুর ফোন নাকি এভাবে গেছে। ফার্মগেটের তিন নম্বর গাড়িতে ঠেলাঠেলি করে যখন সে উঠছে, তখনই নাকি বুঝতে পারল তার পকেট থেকে কেউ ফোনটা নিয়ে নিল। কিন্তু হায়! জনসমুদ্র...তুমি কাকে কী বলবে? কাকে ধরবে? ব্যস,...শেষ, গল্পের ও ফোনের ইতি। বন্ধু বলেছিল, ‘ওঠার আর নামার সময় খুব সাবধান থাকবি, ওই সময়ই জিনিস নেওয়া সহজ।’ সহজ? কতটা সহজ? এই মেয়েটা নামবে, আমি তার পিছু পিছু যাব, তারপর বাস থেকে একেবারে নামার মুহূর্তে ছোট্ট একটা ধাক্কা দিয়ে হাতে আলগোছে রাখা ফোনটা নিয়ে ফুটে যাওয়া...এতটাই সহজ? তারপর লুকিয়ে যাওয়া, গা ঢাকা দেওয়া। ব্যস, কেল্লা ফতে! ফোনটা কোনো গলির ভেতর গিয়ে, চিপার ভেতর গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব অফ করে দিতে হবে—এসব আমার জানা। ব্যাটারি খুলে সিমটা ফেলে কদিনের জন্য ফোনে কোনো সিমই ঢোকালাম না;
তারপর একদিন নিজের নতুন একটা সিম ঢুকিয়ে ব্যবহার করতে লাগলাম আর বন্ধুবান্ধবকে বললাম আন্টি গিফট করেছে।
এখানে এসে আমার চিন্তায় একটু ব্যাঘাত ঘটল। বাসটাও তাদের এক কাউন্টারে দাঁড়িয়েছে; মেয়েটা নেমে যায় নাকি, কে জানে! নাহ্, কেউ তো নামলই না, বরং আরও গাদাগাদি ঠাসবুনটের বাস হয়ে দাঁড়াল এবং আমার জন্য আরও সুবিধাই হলো বলা যায়। ‘যত ভিড় তত মজা চুরির কামে’—কে যেন বলেছিল, ভুলে গিয়েছি। যা-ই হোক, ওই মুঠোফোনে নিজের সিম ঢোকানো বোধ হয় ঠিক হবে না, এখন নাকি গোয়েন্দা বিভাগ বা র‌্যাব খুব সহজেই চালু থাকা ফোন লোকেট করতে পারে। তাহলে, তাহলে বিক্রি; হ্যাঁ, এইটাই হবে একমাত্র সুব্যবস্থা! কোনো বন্ধুর বন্ধুর কাছে, কিংবা ও রকম কোনো দোকানে যারা সেকেন্ডহ্যান্ড ফোন কিনে নেয়; দাম অবশ্য একটু কমই পাওয়া যাবে, কিন্তু আমার নিজের ফোনটাও বিক্রি করে ওই মডেলের হ্যান্ডসেট দিব্যি পাওয়া যাবে। তাহলে বিক্রিই ঠিক! একটা ধাক্কা, অল্প একটু রিস্ক...অল্প একটু কি? রিস্ক কিন্তু ভালোই...মেয়েটা যদি চিৎকার করে ওঠে বা আমার হাতটাই খপ করে ধরে নেয়! আর চারদিকে যে মানুষ, পিটিয়ে হয়তো মেরেই ফেলবে; হয়তো পুলিশে দেবে, পত্রিকায় ছবিসহ নাম আসবে; সবাই দেখবে। আমার বুড়ো বাপটা তো হার্ট অ্যাটাকেই মারা যাবেন। আর আম্মা...তিনি তো রাত-দিন শুধু আমার গুণগান করেন এপাড়া-ওপাড়া—তিনি নিশ্চয় পাগল হয়ে যাবেন। আমার বন্ধুবান্ধবের কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না! আর নীলা...! ছি ছি...নীলা তো আমাকে বিশ্বাস করে ঈশ্বরের মতো! সে যখন জানবে, আমি একটা মুঠোফোন চুরি করতে গেছি...সে হয়তো ছাদ বেছে নেবে, কিংবা সিলিং...
কালো রঙের ফোন, স্লাইড, বোতামগুলো আভা ছড়ায়...আহা, হবে হবে...এর চেয়েও ভালো কোনো ফোন আমার হবে—হাতে নিয়ে ঘুরব। লোকজন দেখবে, আর কেউ কেউ হয়তো আমার মতোই ভাববে। হা হা হা...আমার গন্তব্যের কাউন্টার চলে এসেছে। আরও কয়েকজন নামছে, কয়েকজন উঠছেও, কে আগে নামবে, কে উঠবে—এ নিয়ে এন্তার হাঙ্গামা। ফোনটার দিকে আরেকবার তাকালাম। হবে, হবে। একেবারে পিঠের ওপর ধাক্কা দিয়ে মানুষ নামছে, আরে বাবা, আমিও তো নামব, তাই না! আহ্, দিল পা-টা মাড়িয়ে, স্যান্ডেলের এ অবস্থা নিয়ে নীলার কাছে যাওয়া যাবে? ওফ্, অবশেষে বাস থেকে নামা গেল। মনে হলো, একটা গেরিলা ট্রেনিং নিলাম। এবার নীলাকে ডাকতে হয়...দুজন মিলে আজ শুধু ঘোরাঘুরি...ডান পকেট থেকে মুঠোফোনটা বের করতে গিয়ে দেখি, নেই...এক দুই তিন চার...কোনো পকেটেই নেই। মানে! মানে, আমার মতো আরও কেউ ভাবে, তারপর ভাবনাটাকে কাজে লাগায়। নচ্ছাড়ের দল!


(প্রকাশ: ছুটির দিনে । তারিখ: ১৩-১১-২০১০)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন