মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০১৫

হিমুর হাতে কয়েকটি ব্যালট পেপার

..গতকালই ছোট খালা এসেছিলেন হিমুর কাছে। ভোটার নম্বর দিয়ে গেছেন। হিমু নির্বিকার। ছোট খালু ভোটে দাঁড়িয়েছেন। সবাই সুন্দর সুন্দর প্রতীক পায়, ছোট খালু পেয়েছেন গাধা। এ নিয়ে ছোট খালা অনেক চিল্লাফাল্লা করেছেন, লাভ হয়নি। ছোট খালু অবশ্য মেনে নিয়েছেন। গম্ভীর মুখে বলে বেড়াচ্ছেন, ‘গাধা উপকারী প্রাণী। গাধা মার্কায় দিলে ভোট, শান্তি পাবে নগরের লোক!’
পোস্টারে গাধার ছবির  ছোট খালুর হাস্যমুখ ছবি। পোস্টার দেখে হিমু প্রথমে খালুকে চিনতেই পারেনি। ছোট খালা বলেছিলেন, ‘চোখ পিটপিট করে কী দেখছিস? নিজের রক্তের খালুকে চিনতে পারছিস না নাকি?’
হিমু ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেলেছিল। খুব এক্সাইটমেন্ট থাকলে ছোট খালার কথার ঠিক–ঠিকানা থাকে না। গত রাতে যেমন যেমন ভোটার নম্বর দিতে এসে বললেন, ‘শোন, তুই আমার পর কেউ না, তোর খালুও তোর পর না!’
: এটা নতুন করে বলার কী আছে!
: আছে। অবশ্যই আছে। মিথ্যা কথা বারবার বলতে হয়। তোকে এত দিন পর করে রেখেছিলাম, এখন তোর খালু ভোটে দাঁড়িয়েছে বলে আবার আপন করতে আসছি।
এতটুকু বলে ছোট খালা যেন কয়েকবার খাবি খেলেন। মুখটা ডাঙায় ওঠা মাছের মতো ছোট-বড় হলো। তারপর বললেন, ‘শোন, মানুষ নিজের লোকের জন্য কত কী করে, তুইও আমাদের জন্য করবি।’
: আমি কী করব?
: আরে গাধা, ভোট দিবি। গাধা মার্কায় সিল মারবি। গাধা মার্কায় দিলে ভোট, শান্তি পাবে দেশের লোক।
: দেশের লোক মানে? নির্বাচন জাতীয় পর্যায়ে হচ্ছে নাকি?
: চুপ, গাধা! নির্বাচন যে পর্যায়ই হোক, সব সময় দেশের লোক টেনে কথা বলতে হয়। এতে প্রার্থীর ওজন ভারী হয়।
: ছোট খালু তো এমনিতেই ছোটখাটো পর্বত। এর চেয়ে বেশি ওজন হলে কুমড়োপটাশ হয়ে যাবে না?
: চুপ, বেয়াদব! খালু তোর শালা লাগে যে ইয়ার্কি করছিস! সে তোর রক্তের খালু!
হিমু আরেকবার নিশ্বাস ফেলল। বুঝতে পারল, ছোট খালা খুবই উত্তেজনার মধ্যে আছেন। তাঁর নাকের পাটা কিছুক্ষণ পর পর ফুলে উঠছে। ছোট খালা এক তাড়া কাগজ বাড়িয়ে দিলেন হিমুর দিকে। বললেন, ‘নে এগুলো।’
: এগুলো কী?
ছোট খালা ষড়যন্ত্র করার মতো বললেন, ‘ব্যালট ব্যালট!’
হিমু খুবই বিস্মিত হলো। বলল, ‘ব্যালট মানে? ভোট তো কাল! আজ তুমি ব্যালট পেলে কোথায়?’
ছোট খালা বিরক্তমুখে বললেন, ‘কোথায় পেলাম, কীভাবে পেলাম তোর জানার দরকার নাই। দশটা ব্যালট আছে। দশটাতেই গাধা মার্কায় সিল মেরে বাক্সে ভরে আসবি, বুঝলি?’
হিমু বুঝল কি না, বোঝা গেল না। ছোট খালা বললেন, ‘তুই এই দশটা ভোট দিলে ঢাকা-থাইল্যা´ঢাকা প্লেনের টিকিট ফ্রি! কোনো বান্ধবীকে নিয়ে তিন দিন লটর-ঘটর করে আসতে পারবি!’
: আমার তো কোনো বান্ধবী নাই।
: তাহলে কোনো বন্ধুকে নিয়ে যাবি, গাধা!
বলেই ছোট খালা মনে মনে কাটলেন। বললেন, ‘তোকে বারবার গাধা বলা ঠিক হচ্ছে না। তোর খালু শুনলে খুব মাইন্ড করবে। ভোটে দাঁড়ানোর পর লোকটা কথায় কথায় মাইন্ড করে। আমি আছি মহা যন্ত্রণায়!’
আজ ভোট। হিমুর হাতে ছোট খালার দেওয়া ফাকা ব্যালট পেপার। হলুদ পাঞ্জাবি পরে হিমু এসেছে ভোটকেন্দ্রে। পাঞ্জাবিতে পকেট নেই বলে ব্যালট পেপারগুলো হিমুকে হাতেই ধরে রাখতে হচ্ছে। ভোটকেন্দ্রের গেটেই একজন পুলিশ। সে লেবুপানিঅলার কাছ থেকে লেবুপানি খাচ্ছে। বিক্রেতা ছেলেটা খুবই করুণ মুখ নিয়ে পুলিশের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ধরেই নিয়েছে, এই লেবুপানির টাকা সে পাবে না। হিমু পুলিশের দিকে এগিয়ে গেল। পুলিশটা কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করল। বলল, ‘আপনি কে? সাংবাদিক? আপনার ক্যামেরা কই?’
: আমি সাংবাদিক না। আমার কোনো ক্যামেরা নাই।
পুলিশের চোখের সন্দেহ আiI গাঢ় হলো। বলল, ‘পাঞ্জাবির ভেতরে লুকায় রাখছেন নাকি? আপনাদের তো কোনো বিশ্বাস নাই। এখানে–সেখানে ক্যামেরা রাইখা আমাদের সাথে কথা বলতে আসেন। তারপর কইরা দেন চিচিং ফাঁক!’
: ক্যামেরা না। অন্য একটা ব্যাপার আছে।
পুলিশ হিমুকে এক পাশে টেনে নিয়ে গেল। বলল, ‘কী ব্যাপার? ক্যান্ডিডেট আছে কেউ?’
: জি, আছে।
পুলিশের মুখটা চকচক করে উঠল। বলল, ‘কে?’
হিমু বলল, ‘গাধা মার্কা।’
পুলিশ উদাসকণ্ঠে বলল, ‘তাইলে আর কী! যানগা, ভোট দেন! আমি ভাবলাম ডুপ্লিকেট মারতে আসছেন!’
: আমার হাতে জাল ভোট। ১০টা। গাধা মার্কায় দেওয়ার জন্য।
: ও আচ্ছা। চুপচাপ সিল মাইরা চইলা আসেন।
হিমু চুপচাপ সিল মারার জন্য ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ঢুকল। লম্বা একটা লাইন। হিমু সেই লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরের লোকজন দেখতে লাগল। চাiদিকে গাধা মার্কার লোকজন। সবার বুকে গাধার ছবি, মাথায় গাধার ফেট্টি। মনে হচ্ছে সবাই যেন গাধা হতে পেরে খুশি। হিমু ছোট খালুর প্রতিদ্বশকুন মার্কার লোকদের দেখতে পেল না। না পোলিং এজেন্ট, না অন্য কেউ। ভেতরে প্রিসাইডিং অফিসার বসে আছেন। হিমু তার কাছে গিয়ে বলল, ‘হ্যালো, গুড মর্নিং। আমার কাছে জাল ভোট আছে।’
প্রিসাইডিং অফিসার অবিরক্তমুখে বললেন, ‘সবার কাছেই আছে। এতে এত গর্ব করার কিছু নাই। যান, ভোট দিয়ে চলে আসেন।’
বলেই প্রিসাইডিং অফিসার পিচিক করে থুতু ফেললেন। হিমু তার হাতের ব্যালট পেপারগুলো নিয়ে তৈরি। হঠাৎ হইচই। দশ–বারোটি ছেলে দড়াম করে দরজা খুলে ভোটকেন্দ্রের ভেতর ঢুকে গেল। তাদের হাতে লাঠিসোটা। সবার মধ্যেই অস্থিরতা। একটা ছেলে বলে উঠল, ‘কত আসছে, কত আসছে, অ্যাঁ? দুপুরের মধ্যে এখানে দশ হাজার লাগবে!’
প্রিইডিং অফিসার মিনমিন করে বললেন, ‘কিন্তু এই কেন্দ্রে তো ভোট মাত্র আট হাজার!’
ছেলেটা ধমকে উঠল। বলল, ‘আর দুই হাজার ভোট তাইলে পয়দা করেন। কেমনে করবেন, আমরা জানি না!’
প্রিইডিং অফিসারের কণ্ঠ খাদের কিনারায় নেমে গেল। প্রায় ফিসফিস করে বললেন, ‘সম্ভব না।’
ছেলেটা বলল, ‘কী করে সম্ভব হয় আমরা দেখাইতেছি। আপনারা বইসা বইসা খালি দেখেন!’
সঙ্গে সঙ্গে অন্য ছেলেরা তাদের হাতের লাঠি দিয়ে টেবিল আর বেঞ্চে আঘাত করতে লাগল। ভয়ংকর পরিবেশ। কয়েকজন আবার ভোটের বাক্সগুলো তুলে নিয়ে গেল। হিমু ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এল। তার হাতে জাল ভোট। সে এগিয়ে গেল লেবুপানিঅলার কাছে। বলল, ‘এই জাল ভোটগুলোর বদলে আমাকে এক গ্লাস লেবুপানি দেওয়া যাবে?’
লেবুপানিঅলা বলল, ‘তিয়াস লাগছে, মাগনা পানি খান। এইসব হাবিজাবি জিনিস নিয়া আমি কী করব!’
ভোটকেন্দ্রের ভেতর নারকীয় । হিমু ঢকঢক করে লেবুপানি খাচ্ছে। নেব না নেব না করেও লেবুপানিঅলা ছেলেটা জাল ভোটগুলো নিল। সেগুলো দিয়ে সে তার স্টোভ জ্বালানোর চেষ্টা করছে।

(হু্মায়ূন আহমেদের ‘হিমু’ চরিত্রের ছায়া অবলম্বনে)

রস+আলোয় প্রকাশিত
লিংক:
http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/518758/%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%9F-%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন