শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫

ফেসবুকের আগে ও পরের জীবন


..আগের জীবনঘড়ির অ্যালার্ম শুনে ঘুম ভেঙে তাড়াতাড়ি পরীক্ষা দিতে গেল মইন।
পরের জীবনসারা রাত জেগে ফেসবুকিং করেছে মইন। সকালে তাই অ্যালার্ম বাজার পরও ঘুম ভাঙল না তার। ১০ মিনিট পর আবার অ্যালার্ম বাজল। মইন উঠল না। আরও আধা ঘণ্টা পর মইনের মা এসে ডাকলেন। অনবরত ডাকের পর মইনের মাথার ভেতর ‘ওএমজি’ করে উঠল। সে ধড়ফড় করে উঠে বসল। কিছুক্ষণ কিছুই বুঝল না। তারপরেই মনে পড়ল, তার পরীক্ষা। গত রাতে এ নিয়ে সে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিল, তার মনে আছে। লিখেছিল, ‘ফ্রেন্ডস, কাল এক্সাম! বাট প্রিপারেশন নাই! এত এক্সাম কেন জীবনে?’ তারপর অনেকগুলো কষ্টের ইমো।
ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সেই স্ট্যাটাসে ছিল এক শ সাতটা লাইক আর মাত্র চারটা কমেন্ট। মইনের মনে হলো এক্ষুনি তার রেডি হয়ে পরীক্ষার জন্য বেরোনো দরকার। কিন্তু একবার স্ট্যাটাস চেক না করেই? সে দ্রুত তার ফেসবুকে ঢুকল এবং ঢুকে একটু বিষণ্ণবোধ করল। লাইকের সংখ্যা আর মাত্র দুটি বেড়েছে। তবে মইন খুব বেশি হতাশ হলো না, কেননা সকাল হলো ফেসবুকের অফপিক সময়। সারা রাত ফেসবুকিং করে সবাই এখন ঘুমিয়েছে। মইন তাই আশায় আশায় তৈরি হতে শুরু করল।
টি-শার্ট, জিনস চাপিয়ে বের হতেই দেখল রাস্তায় হাঁটুপানি। সারা রাত বৃষ্টি হয়ে গেছে, সে কিছুই বোঝেনি। ফেসবুকেও কেউ আপ দেয়নি। নাকি তার এলাকায়ই শুধু বৃষ্টি হয়েছে? ব্যাপারটা ফেবুতে জানানো দরকার। ওদিকে এক অফিসগামী লোকের রাস্তা পার হতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! মইন তাড়াতাড়ি ফোন বের করে ছবি তুলল। পরীক্ষা পরে, আগে এই দুর্ভোগের কথা সবাইকে জানাতে হবে! ছবি তোলার সময় লোকটা একটু অদ্ভুত দৃষ্টিতে মইনের দিকে তাকাল বটে, হয়তো আশা করছিল মইন তাকে সাহায্য করবে, কিন্তু মইন তার চেয়েও বড় ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলো। সে ছবিটা ফেসবুকে আপ করে দিয়ে লিখল, ‘মহাখালী এখন মহাপানি...যারা বাইর হবেন, নৌকা নিয়া বাইর হন!’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা সামাজিক কাজ করার পর মইনের মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল, দিনটা শুরুই হলো একটা ভালো কাজ দিয়ে। কিন্তু মনের ভেতর একটা খচখচানি—পরীক্ষা নিয়ে দেওয়া তার স্ট্যাটাসটা হিট করল না! তাকে কেউ তেমনভাবে শুভকামনাও জানায়নি। দেবে নাকি আরেকটা স্ট্যাটাস?
দিয়েই দিল। লিখল, ‘হাই ফ্রেন্ডস, এক্সাম দিতে যাচ্ছি। দোয়া কইর!’
এবার আর দোয়া না করে বুদ্ধি কী? খুশিমনে রিকশায় চেপে বসল মইন। ওহ যানজট! যানজট আর যানজট! এই দেশের কী হবে? যানজটে বসে আছে আর বিরক্তি লাগছে মইনের। ওদিকে পরীক্ষা...দূর...ফেসবুকে কী হলো? কয়টা লাইক পড়ল তার স্ট্যাটাসে? দেখা দরকার।
না লাইক বেশি পড়েনি, কিন্তু কমেন্ট পড়েছে কয়েকটা। একজন লিখেছে, ‘ভাইজান, ভালোমতো পরীক্ষা দেন!’
আরেকজন লিখেছে, ‘পরীক্ষা দিতে যাইতেছেন, পরীক্ষা দেন...এই পরীক্ষা পরীক্ষা কইরা চব্বিশ ঘণ্টায় পঁচিশটা স্ট্যাটাস দেওয়ার মানে কী?’
তৃতীয়জন লিখেছে, ‘তুই তো পরীক্ষায় নির্ঘাত ফেল করবি! তুই পড়লি কখন! সারাক্ষণই তোরে ফেবুতে পাই!’
মনটা বিষিয়ে গেল মইনের। ফেসবুকে সব বদমানুষের ভিড়। সিদ্ধান্ত নিল আর কখনোই সে ফেসবুক ব্যবহার করবে না। এবং ব্যবহার যে করবে না এটা সে সবাইকে জানিয়ে দেবে। তাই ফেসবুকে লিখল, ‘বন্ধুরা, চিরবিদায়। না পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছি না...কিন্তু আর কখনো ফেসবুকে আসব না! তোমাদের সবাইকে মিস করব!’
রিকশা চলতে শুরু করেছে। মইনের মন কেমন যেন দ্রবীভূত হতে শুরু করেছে। সত্যিই কি সে আর ফেসবুকে ঢুকবে না? কিন্তু তার যে স্ট্যাটাস, সেখানে কে কে কমেন্ট করল? কেইবা লাইক দিল তার ওই বিদায়ী স্ট্যাটাসে? আহারে, কেউ কি তাকে বলবে না—ফিরে এসো!
মন খারাপ আর সঙ্গে একটা অদ্ভুত ছটফটানি নিয়ে মইন পরীক্ষা দিতে শুরু করল। প্রশ্নপত্রে যা আছে তার সবই প্রায় কমন। তবুও মনটা তার ভালো হচ্ছে না। আজ যদি সে ফেসবুক পরিত্যাগের ঘোষণা না দিত, তাহলে একটা অন্তত সেলফি তোলা হতো এখন। লিখত, ‘এক্সামফি...লল!’
কিন্তু হায়! মইনের হাত কেঁপে কেঁপে গেল। পরীক্ষা শেষ হলো তার। ভালোই হলো পরীক্ষা। কিন্তু মুখটা তার শুকনোই থেকে গেল। বন্ধু অরণী এগিয়ে এসে বলল, ‘কিরে, তুই নাকি কুইট করেছিস ফেসবুক থেকে?’
মইন মাথা নাড়ল। অরণী বলল, ‘কুইট করে লুজাররা! তুই ক্যান করবি? আমাকে দেখ, আমাকে কতজন ডিস্টার্ব করে ফেসবুকে, আমি কি কুইট করেছি?’
বুক থেকে পাথর নেমে গেল যেন মইনের। সে সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে ঢুকল। কতজন তাকে নিষেধ করেছে ফেসবুক ছেড়ে যেতে! মইনের চোখে পানি চলে এল। ছলছল চোখে অরণীকে বলল, ‘দোস্ত, আমার সঙ্গে একটা সেলফি তুলবি? ফেসবুকে আপ করে জানাব, আমি আবার ফিরে এসেছি...!’

প্রকাশ: রস+আলো

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন