মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৩

একটি অবৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি














সময়ের আগে, ভোরবেলা, ঘুম ভাঙলো প্রধানমন্ত্রীর।

এখনো আলো ফোটে নি। টেবিল ঘড়িতে সময়টা দেখে বিরক্ত হলেন তিনি। এ সময়ে তাঁর ঘুম ভাঙার কথা না। সারাদিন এতো কাজ থাকে, এতদিকে ছুটতে হয়, এত সব সামলাতে হয় যে একটু জিরোবারও সময় পান না; এরমধ্যে যদি ঘুমটাও ঠিকভাবে না হয় তাহলে আর টিকবেন কীভাবে?
নাকটা কুচকালেন তিনি। কোথায় যেন একটা গন্ধ। কিসের গন্ধ?
গতরাতে শোয়ার পর গন্ধটা একটু পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু আমলে নেন নি। ইদানিং কোনো কিছুই তাঁর আর আমলে নিতে ইচ্ছা করে না।
কিন্তু এই ভোরে গন্ধটা একবারে চেপে বসেছে যেন। ঘর ভারী করে ফেলেছে দুর্ঘন্ধটা। তিনি ঝটপট উঠলেন বিছানা থেকে। খাটের নিচটা দেখার চেষ্টা করলেন। কোনো চিকা মরে আছে নাকি? কেউ চিকা মেরে গেছে কিনা, কে জানে!

না, কোনো চিকা টিকা নাই। তাহলে? গন্ধটা অসহ্য লাগছে তাঁর। মনে হচ্ছে সহ্য করতে পারবেন না। নাকে শাড়ির আঁচল চেপে তিনি বাইরে বেরিয়ে আসেন। বাইরের বাতাসে কিছুটা সুস্থবোধ করেন। মনে হয় প্রাণটা ভরে গেল। বাতাসটা দারুণ হালকা হয়ে আছে।
কিন্তু পরক্ষণেই বদগন্ধটা আবার পেলেন তিনি। তীব্র। মনে হলো ধাক্কা দিলো তাঁকে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন নিচে। বাইরেটা অনেকখানি খোলা। বেশ বড় মাঠের মতো। প্রহরীরা তাঁকে দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। সালাম দিলো। প্রধানমন্ত্রী সালাম নিলেন। বললেন, আপনারা কোনো গন্ধ পাচ্ছেন?

এক প্রহরী লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখে। সে নিজেকে জাহির করার সুযোগ হাতছাড়া করলো না। বলল, শীত এসে গেছে মহামান্য। বাতাসে শীতের গন্ধ।
-শীতের গন্ধ?
-হ্বী। শীতের গন্ধ মহামান্য। শুকনা শুকনা। মনে হয় পারস্যের গোলাপের মমি!
-আপনি সত্যি প্রহরী, না অনুচর?

কবি-প্রহরী চুপ করে থাকলো। সে ভাবলো প্রতিভা জাহির করতে গিয়ে আজ বোধহয় চাকরিসহ প্রাণটা খোয়াতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দয়ালু। বা তিনি আজ অন্যকিছুতে ব্যস্ত। হতে পারে গন্ধ নিয়ে তিনি চিন্তামগ্ন। তিনি পায়ে পায়ে প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রহরীরা তাঁর পিছু নিলো। প্রধানমন্ত্রী পেছন ফিরে প্রহরীদের আসতে নিষেধ করলেন। কিন্তু প্রধানপ্রহরি বলল, মহামান্য, আপনার সাথেই আমাদের থাকতে হবে!

প্রধানমন্ত্রী সাধারণত বিরক্ত হোন না। প্রহরীদের সাথে তো হনই না। কিন্তু আজ হলেন। হতে পারে গন্ধটা তাঁকে ঠিকমতো চিন্তা করতে দিচ্ছে না। তিনি কড়াকণ্ঠে বললেন, কে এখানে প্রধানমন্ত্রী? আপনারা, নাকি আমি?

প্রহরী-প্রধান চুপ করে থাকল। প্রধানমন্ত্রী বললেন, একটা গন্ধ আমাকে ঘিরে রেখেছে, আপনারা বুঝতে পারছেন না। হতে পারে শীতে আপনাদের নাক বন্ধ। আমাকে একটু হাঁটতে হবে, আমাকে বাইরে যেতে হবে...

প্রহরী-প্রধান বলল, জ্বি জ্বি অবশ্যই যাবেন মহামান্য। তবে আমরা যদি আপনার পিছে পিছে থাকি তাহলে তো প্রব্লেম হবে না। না থাকলেই বরং প্রব্লেম!

প্রধানমন্ত্রী ছোট্ট একটু শ্বাস ফেলে বললেন, আসুন। পেছনে পেছনে আসুন...

প্রধানমন্ত্রী বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। রাস্তা ফাঁকা। সকালবেলার রাজধানী এখনো জাগে নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জানতেন এ নগরী নাকি কখনো ঘুমায় না! ফাঁকা রাজধানী দেখে তাঁর ভালো লাগল না। তিনি আশে-পাশে তাকালেন। নাহ, কেউ নেই। কিন্তু গন্ধটা আছে, বাজে একটা গন্ধ। আততায়ীর মতো গন্ধ।
প্রধানমন্ত্রী জোরে হাঁটা শুরু করলেন। তিনি হয়তো চাইলেন জোরের সাথে হেঁটে গন্ধটাকে অতিক্রম করবেন।

প্রধান সড়ক ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী একটা গলিরাস্তায় ঢুকলেন। রাস্তায় শুকনো পাতা পড়ে রয়েছে। শুকনো পাতা তাঁর পছন্দ না, তিনি পছন্দ করেন কচি সবুজ পাতা। সবুজ সবুজ পাতা দেখার জন্য তিনি ওপরে তাকালেন। কিন্তু হায়, শীতে সব পাতা ঝরে গেছে। গাছ পত্রপুষ্পহীন। কিছু কিছু গাছ পুড়ে কয়লা হয়ে আছে। গাছদের এমন দুঃস্থাবস্থা দেখে প্রধানমন্ত্রীর খুব খারাপ লাগল। কষ্ট হতে লাগল। গন্ধটা যেন আরো জেঁকে বসলো তাঁর বুকে। তিনি কয়েকবার বড় বড় প্রশ্বাস ফেলে গন্ধটাকে তাড়িয়ে দিতে চাইলেন, কিন্ত পারলেন না।

গলিরাস্তাটা পেরিয়েই দেখলেন একটা পোড়া বস্তি। একদিন গাড়ি করে এ বস্তির পাশ দিয়ে তিনি গিয়েছিলেন। তিনটা পরিবার এখানে বাস করতো। তাঁর গাড়ি দেখে পরিবারগুলো থেকে লোকজন বেরিয়ে এসেছিল। পরিবারগুলোর অনেকগুলো শিশুপুত্রকন্যা ছিল। তাঁর গাড়ি দেখে ছেলেমেয়েগুলো হাত তুলে, পতাকাকে যেমন সালাম করে, অবিকল একইরকমভাবে তাঁকে সালাম করেছিল। তাঁর খুব ভালো লেগেছিল। বুক ভরে এসেছিল। কোনো কারণ ছাড়াই চোখের কোণাটা ভিজে উঠেছিল। তিনিও হাত তুলে ছেলেমেয়েগুলোর সালাম গ্রহণ করেছিলেন।
আজ ওই বস্তির ঘরগুলো নেই। তার বদলে রাস্তায়, দেয়ালে পোড়া পোড়া বিচিত্র দাগ। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টই একটা হাহাকার অনুভব করলেন। তিনি আরো জোরে হাঁটতে শুরু করলেন। পেছনের প্রহরীরা তাঁর সাথে তাল সামলাতে পারছিল না।

প্রধানমন্ত্রী গলিরাস্তা ছেড়ে একটা পুরনো ও বিখ্যাত বাজারের সামনে দাঁড়ালেন। বাজার খালি। কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। বুকের ভেতরের হাহাকারটা আবার ফিরে এলো তাঁর। আর গন্ধটা তো ছিলোই। এখন মনে হচ্ছে গন্ধটা তাঁকে কবর দিয়ে ফেলবে। খুবই কুৎসিত একটা গন্ধ। পচা, জঘন্য একটা গন্ধ।

এমন সময় বিস্ময়টা দেখলেন প্রধানমন্ত্রী। দেখলেন অপরদিকের রাস্তা ধরে একা একা হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসছেন প্রধান বিরোধী নেতা। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু যেন একটা খুঁজছেন তিনি। কেমন যেন ছটফট করছেন।

প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে গেলেন প্রধানবিরোধীর কাছে। প্রধানবিরোধী বললেন, আপা, গন্ধটা পাচ্ছেন?
প্রধানমন্ত্রী বললেন, আপনিও গন্ধ পাচ্ছেন?
-হ্যাঁ খুবই তীব্র আর বাজে গন্ধ!
-একদম জঘন্য গন্ধ। মনে হচ্ছে মরে যাবো।
-হ্যাঁ মনে হচ্ছে মরে যাবো! কীসের গন্ধ?

প্রধানমন্ত্রী চারদিকে তাকালেন একবার। খা খা রাজধানী। তিনি ছোট্ট করে শ্বাস নিয়ে বললেন, প্রথমে আমিও বুঝি নি। কিন্তু হেঁটে হেঁটে দেখতে দেখতে বুঝলাম গন্ধটা এই দেশের... দেশটা পঁচে যাচ্ছে, গলে যাচ্ছে!
প্রধান বিরোধী বললেন, ঠিক গন্ধটা দেশের। পচন শুরু হওয়া দেশের। বাংলাদেশের।
প্রধানমন্ত্রী বললেন, এখন আমরাই পারি দেশটার পচন রোধ করতে।
প্রধানবিরোধী বললেন, হ্যাঁ আমরাই আবার শাপলা গোলাপ ফোটাতে পারি।

প্রধানমন্ত্রী বললেন, হ্যাঁ আমরা চাইলেই নতুন পাতা গজাবে গাছে গাছে। দিকে দিকে আবার কোকিল ডাকবে।

প্রধানমন্ত্রী আর প্রধানবিরোধী দু'জন দু'জনের দিকে তাকালেন, মনে হয় অনেক দিন পর তাকালেন। তারপর তারা হাত ধরলেন, বোধহয় অনেক দিন পর হাত ধরলেন। প্রথমে তাদের সংকোচ হচ্ছিল, কেমন জানি লাগছিল। কিন্তু হাতটা ধরার সাথে সাথে কোথা থেকে একটা সুগন্ধ ভেসে এলো। তাঁরা আবার পরস্পরের দিকে তাকালেন। একটু হাসলেন। আর মনে হলো রাজধানী হেসে উঠল, দেশটা হেসে উঠল।

তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে একটা সুগন্ধ এবার জড়িয়ে থাকল জ্যোতির্ময় হয়ে। হতে পারে সুগন্ধটা কোনো গোলাপের, বা কাঠালিচাপার, বা বাংলাদেশের।


(বি:দ্র: এটি একটি অবৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি মাত্র। ভবিষ্যতের কোনো রাষ্ট্র, কোনো রাজধানী, কোনো প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানবিরোধী নিয়ে এ গল্প রচিত।)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন