শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

শ্যামল ছায়া


আপনাকে কখনো চিঠি লেখা হয়নি।

শিক্ষাজীবনে লিখতাম আম্মাকে, তাতেই থাকত ভালোমন্দের জিজ্ঞাসাবাদ, চাহিদার সাতকাহন।অবশ্য আপনি জানতেন সবই; আমার সব চাওয়া পরোক্ষে থাকত তো আপনারই কাছে! এই ছলটুকু আপনি বুঝতেন, চাওয়াগুলো পাওয়া হতে কখনো তাই দীর্ঘ সময় নেয়নি। তারপর এল মুঠোফোনের কাল। ফুৎকারে উড়ে গেল চিঠিপত্র। মুঠোফোনেও আপনার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারি না, বুকে থাকে পাথরভার। এ কেবল পুত্রের সঙ্গে পিতার দূরত্ব নয়, আরও কিছু। এখন আপনি ৭০ পার করেছেন, আমি মাত্র ২৮।বয়সের এই ভার কিন্তু দূরত্বের কারণ নয়।মনে পড়ে, শৈশবে আপনার তর্জনী ধরে, দুজনে গল্প করতে করতে বাড়ি থেকে যেতাম আমাদের খামারবাড়িতে, যাকে আমরা ডাকতাম ‘ও বাড়ি’ বলে।ছোট পরিসরে কত কিছুই না করেছিলেন আপনি! দুটো মাটির ঘর ঘিরে এক পাশে মৌসুমি সবজির খেত, অন্য পাশে মাছভর্তি ছোট্ট পুকুর, আর পুকুর ঘেঁষে বাতাবি লেবুর যমজ গাছ, যেন শুয়ে থাকত পুকুরের বুকের ওপর। পাকা হলুদ লেবু ভেসে থাকত

পানিতে। অন্য পাশে কিছু ফুলের গাছ—গাঁদা-গোলাপ-সূর্যমুখী-সন্ধ্যাতারা-মোরগ ফুল। আরও কত রকমের যে গাছ! আপনার বৃক্ষপ্রীতি ছিল।আপনি বলতেন, গাছের গুরুত্ব এখন কেউ বুঝছে না, কিন্তু একসময় দেখবি সবাই পরিকল্পনা করে গাছ লাগাবে। বেশি সময় যায়নি, ক বছর পর থেকেই সরকারি উদ্যোগে গাছ লাগানো শুরু হয়। আপনার মুখে তখন ‘কি, বলেছিলাম না’ ধরনের হাসি। আমার বয়স তখন কত? ছয়-সাত-আট...। আপনার কৃপায় আমার শৈশব শ্যামল থেকেছে আম-জাম-কাঁঠাল- কলা থেকে শুরু করে কদম-পাকুর হরীতকী-তেজপাতাগাছের ছায়ায়। আপনার সঙ্গে খেতে ছড়িয়ে দিয়েছি রবিশস্যের বীজ, মাটিতে বীজ ছড়ানোর যে কী আনন্দ! সে বীজ থেকে যখন চারাগুলো জন্মায়, এখন বুঝতে পারি, ওই সুখ সৃজনের। মাটির একটি ঘরে থাকত জাহাঙ্গীর, যার দায়িত্ব ছিল পাশের ঘরে থাকা সাদা-কালো দুটো গাভি ও মেটে রঙের একটি ঘোড়ার যত্ন নেওয়া। ঘোড়াটিকে খুব পছন্দ করতাম, পিঠে চড়লে নিজেকে সবার চেয়ে আলাদা মনে হতো, বোধহয় রাজাও! কিন্তু কুৎসিত একটি দিনে পাগলা কুকুর কামড়ে ঘোড়াটিকেও উন্মাদ করে ফেলল।আপনি নিজ হাতে ঘোড়াটিকে গুলি করে মারেন।
আপনার চোখে সেদিন আমি অশ্রু দেখেছিলাম।

তারপর আর কখনো আপনি ঘোড়া পোষেননি, যদিও আপনার প্রিয় বাহন ছিল ঘোড়া। মৃত ঘোড়াটির কবর আমরা দিয়েছিলাম কদমগাছের পাশে।আমি অনেক দিন, বড় হওয়ার পরেও, কদমগাছটির নিচে বসে থাকতাম। আপনার ওই খামারবাড়িটা এখন নেই, পুকুরে মাটি পড়েছে, গাছ কাটা পড়েছে, উঠেছে একতলা-দোতলা বাড়ি। ওখানে গেলে আর কিছু চেনা যায় না, স্মৃতিও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।আমাদের অনেক সুন্দরের মতোই, আপনার তিলে তিলে গড়া ওই তিলোত্তমাকে আমরা হারিয়েছি।আজ আপনি শয্যাগত, মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন, বেঁচে আছেন কেবল ওষুধে; আপনাকে আরও কিছু বলার আছে, জানানোর আছে, আছে কৃতজ্ঞতা-
স্বীকারের, অপরাধ-স্বীকারেরও।কিন্তু আমার গলার মাংসপেশি শক্ত হয়ে আসছে, হাত কাঁপছে। আরেক দিন হয়তো অনেক কথা বলব, আজ শুধু এটুকু বলি, আমাকে এমন কোমল শ্যামল শৈশব দেওয়ার জন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞ চিরকাল। আমার দুঃসময়ে শৈশবের সেই মধুমাখা স্মৃতিগুলো আমাকে আবার বাঁচিয়ে তোলে,
সবুজ রাখে।



(ছুটির দিনে প্রকাশিত।
তারিখ: ২৫-০৬-২০১১)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন