শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

ধুপি


গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর ভুট্টার খই যেভাবে পপকর্ন হয়ে গেছে, সেভাবেই ধুপি হয়ে গেছে ভাপা পিঠা। শীত এসে গেছে।ঢাকায় ধুলা উড়লে শীত বোঝা যায় ভালো।পাতাঝরা বা ঝরাপাতা দুটোই দেখা মুশকিল।একে তো গাছ নেই, তার ওপর গাছের দিকে, পাতার দিকে তাকানোর সুযোগ কই? অমনোযোগী হলেই কোনো গাড়ি চাপা দিয়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। ধুলা উড়ছে, শরীরে খসখসে ভাব; ফুটপাত উপচে শীতের কাপড়ের ঢল...অতএব শীত এসে গেছে। ফুটপাতে ভাপা পিঠার দোকানও বসেছে।আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যাই। প্লাস্টিকের সবুজ বাটিতে সাদা পিঠা, মাঝে গুড়ের লাল অংশ— নারকেলের দুয়েকটা কুচি...। মুখে দিয়ে সেই পুরোনো স্বাদ খুঁজি, নেই। থাকার কথাও নয়।ফিরে যাই। রাতে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হলে অবধারিতভাবেই ধুপির কথা চলে আসে। তিনি বলেন, ‘ধুপি খাবি না বাবা...!শীত তো এসে গেল, কখন আসবি?’মাকে কী করে বলি, চাইলেই যেতে পারি না এখন।এখানে বিঁধে গেছে জীবন। গ্রামে থাকার সময় প্রতি শীতের শুরুতে ধুপি উ ৎসব করতাম। নতুন ধান উঠেছে ঘরে। উঠানে, বারান্দায় ধানের গন্ধ।মা নতুন ধানকে চাল, চালকে ভিজিয়ে ধুপির উপযোগী করে তুলেছেন রাত জেগে।বাবা নিয়ে এসেছেন খেজুরের গুড়-পাটালি। গাছ থেকে নামানো হয়েছে নারকেল। মাতৃস্থানীয় পড়শি আত্মীয়েরা সে নারকেল কুরাচ্ছেন। কুড়কুড় আওয়াজ হচ্ছে বাড়িময়। নানা কথার কলকল আওয়াজে ভরে আছে বাড়ি। একটা যজ্ঞ চলছে যেন।আমি কুরানো নারকেল নিচ্ছি একবার তো আরেকবার পাটালির দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছি হাত।আগের দিনই জানানো হয়েছে বন্ধুদের। সকাল থেকে তারাও হাজির। ধুপি উ ৎসবের খাদ্যরসিক এই বন্ধু সদস্যরা শীতে জবুথবু হয়ে বসে তীর্থের কাকদেরও হার মানাচ্ছে যেন। রান্নাঘর থেকে নতুন চুলা মা নিয়ে এসেছেন আঙিনায়। মাটির ঢাকনার মাথা ফুটো করে দিয়েছেন। সেখান থেকে বাষ্প আসবে, মানে ভাপ আসবে—সেই ভাপে তৈরি হবে ভাপা পিঠা। চালের গুঁড়া তৈরি, পাটালি তৈরি, নারকেল তৈরি—আর কিসের অপেক্ষা! মা বড় বড় বাটিতে চালের গুঁড়া ভরে তার ভেতর কানায় কানায় ছড়িয়ে দেন গুঁড়ো গুঁড়ো পাটালি আর নারকেলের কুচি। তারপর ধবধবে সাদা কাপড়ে তা ঢেলে কাপড়টা জড়িয়ে ঢাকনার ওপর রাখেন। ঢাকনাটা থাকে হাঁড়ির ওপর।হাঁড়ি চুলার ওপর। হাঁড়ির ভেতর পানি। চুলার তাপে সেই পানি টগবগ করে ফুটে বাষ্প হয়ে অল্প অল্প ধাক্কা দিচ্ছে কাপড় ঢাকা চালের গুঁড়ায়। আর ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে ভাপা পিঠা—আমাদের প্রিয় ধুপি।

আধিয়ারের দিয়ে যাওয়া খেজুরের রসে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাচ্ছি মায়ের হাতের বানানো সেই অমৃত, আহা! ফোনে দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। মাকে কেবল বলি, ‘যাব মা। যাব।’ আমি যেমন জানি, মা-ও জানেন, এ শীতেও আমার হয়তো যাওয়া হবে না। ও প্রান্তে মা যে দীর্ঘশ্বাস গোপন করছেন না, কে বলবে! ফোন রাখি। শীত শীত, সেই শীত—সেই বন্ধুরা...সেই খেজুরের রস...মায়ের হাতের সেই ভাপা পিঠা...যাব যাব...এবার নিশ্চয় যাব! অবোধ প্রবোধের মধ্যেই আরেকটি শহুরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিই।




('ছুটির দিনে' প্রকাশিত
তারিখ: ০৩-১২-২০১১)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন