শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

‘পথের পাঁচালী’ আবার দেখার পর


এটা প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হয় যে আমি চলচ্চিত্র বোদ্ধা নই। আমার কাছে ‘টাইটানিক’ যেমন ভালো লাগে তেমনি ‘মনপুরা’ও ভালো লাগে; চলচ্চিত্রে আমি খুবই অসমঝদার দর্শক; ফলে হিন্দি মারমার কাটকাট ছবিও আমি আগ্রহ নিয়ে দেখি। পৃথিবীর তাবৎ অসাধারণ চলচ্চিত্রের আমি প্রায় কিছুই দেখি নি। ফলে এটা বলতেই হয় যে দর্শক হিশেবে আমার কোনো জাত-পাত নেই।

তাহলে এই জাতহীন দর্শক হঠাৎ ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে পড়ল কেনো?

কারণটা অস্বস্তি। ক’দিন আগে, হঠাৎ করেই, আবারও পথের পাঁচালী দেখলাম; এবং দেখার পর থেকে এক ধরনের অস্বস্তি ও তাড়না অনুভব করছি। ওই অস্বস্তি ও তাড়না যদি দূর হয়- এমন আশাতেই লিখতে বসা।

‘পথের পাঁচালী’ আগেও দেখেছি, এবং ভালো লেগেছে। সেই ভালো লাগাটা, কবুল করছি, কিছুটা কপটই। বিভ‚তিভ‚ষণের উপন্যাস, সত্যজিৎ-এর চিত্রনাট্য ও পরিচালনা, ভালো লাগে নি বা কম ভালো লেগেছে- তা বলি কীভাবে? তাছাড়া বিশ্বজোড়া খ্যাত ও পুরষ্কৃত এই ছবি; যদি বলি ভালো লাগে নি, আমার বোদ্ধা বন্ধুরা কি বলবে না যে আসলে আমি চলচ্চিত্রের মাথাটাও বুঝি না? তাই সিনেমাটা যতোটা ভালো লেগেছিল দেখে, তারচেয়েও বেশি ভালো লাগার কথা বলেছিলাম, বলতে হয়েছিল।

আগেই বলেছি, আমি চলচ্চিত্র বোদ্ধা নই এবং এ লেখাটিও ‘রিভিউ’ বলতে বাজারে যা বোঝায় তা নয়। বলা যায়, এটা নিতান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতি, অস্বস্তি ও তাড়না, থেকে লেখা। কেননা কিছু দৃশ্য আমার মাথার ভেতর এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে, ছটফট করছে।

প্রথম যে দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি তা কিন্তু মোটেও অপু ও দূর্গার রেল দেখার দৃশ্য নয়। ওই দৃশ্যটা বিখ্যাত বটে, আমার ভেতর আলোড়নও তৈরি করেছে, কিন্তু তারচেয়েও বেশি যে দৃশ্যটা মাথায় আঠার মতো লেপ্টে আছে তা হলো ঘুম থেকে উঠে অপুর পুকুরপাড়ে যাওয়া। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত মনে কয়লা দিয়ে দাঁতমাজার মতো খুব সাধারণ একটা দৃশ্য আমাকে বেশ ওলোট-পালোট করে দেয়। দৃশ্যটা এতোই সাধারণ যে, চলচ্চিত্রে ব্যবহারের পর দৃশ্যটা লহমায় অসাধারণ হয়ে যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি দৃশ্যটার সাথে নিজেকে ‘রিলেট’ করতে পারি। আশঙ্কা করি, বর্তমান প্রজন্ম এই ‘রিলেট’টা করতে পারবে না। ফলে তাদের কাছে এই দৃশ্যটার কোনো অর্থ থাকবে না, বা অন্য অর্থ বের করবে। কিন্তু আমার কাছে দৃশ্য স্রেফ শৈশবে ফিরে যাওয়ার ‘টাইম মেশিন’। দেখতে পাই ঘুম থেকে উঠে দাঁতের মাজন নিয়ে চলে গেছি পুনর্ভবা নদীর তীরে। ধোঁয়া ওঠা খুব শান্ত ও নিস্তরঙ্গ সকালে মুখের মধ্যে আঙুল গুঁজে পানির দিকে অর্থহীন তাকিয়ে, বা পানিপোকা দেখে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়ার মতো দৃশ্যগুলো এখন পরাবাস্তব মনে হয়। ওই দৃশ্যে ফিরে যাবার জন্য নিজের ভেতর আকুতি তৈরি হয়।

আরেকটা দৃশ্যের কথা মাথার ভেতর বিদ্যুতের মতো ঝলকে ঝলকে যাচ্ছে- সেটা হলো নিশ্চিন্তপুর গ্রামে ময়রার মিষ্টি ফেরি করতে আসা। ময়রাকে দেখেই অপু ও দূর্গার ছুটে গিয়ে দাঁড়ায়। দূর্গা বাবার কাছ থেকে অপুকে দুটো পয়সা নিয়ে আসতে প্রলুব্ধ করে। অপু বাবার কাছে গিয়ে পয়সা না পেয়ে ফিরে এলে অপেক্ষমাণ ময়রা আবার চলতে শুরু করে- আর তার পিছু নেয় অপু, দূর্গা ও একটা কুকুর। দৃশ্যটিতে একটা কুকুরের নিপুন সংযোজনে পুরো দৃশ্যটি একেবারে নগ্ন হয়ে আমাদের চোখের সামনে চলে আসে। মনে পড়ে যায় আমার শৈশবের ফেরিওয়ালাগুলোকে... বরফঅলা, চাটনিঅলা, কটকটিঅলার পিছু পিছু পয়সাহীন ঠিক কুকুরের মতোই কতো যে ঘুরেছি তার ইয়ত্তা নেই। বাংলাদেশের দরিদ্র শৈশবগুলো তো এরকমই ছিল, ঠিক এরকমই ছিল।
এই দৃশ্যটি সত্যজিৎ দেখিয়েছেন পুকুরের পানির ওপর অপু-দূর্গাদের প্রতিবিম্বের মাধ্যমে- আগে আগে ময়রা যাচ্ছে, পেছনে পেছনে অপু, দূর্গা এবং কুকুর। পানির প্রতিবিম্বে দৃশ্যটি দেখানোর নিশ্চয় কোনো অনন্য ব্যাপার রয়েছে, বা নেই- আমি বোদ্ধা নই বলে এগুলো বুঝি না, কিন্তু পানির কম্পিত প্রতিবিম্বে দৃশ্যটি দেখার ফলে ভেতরে ভেতরে কেমন একটা বেদনা তৈরি হয়। অমন একটা দৃশ্যের অংশ আমি নিজে ছিলাম বলেই হয়তো বেদনাটা পাক খেতে থাকে, খেতেই থাকে।
এরপর দৃশ্যটা আমাদের পেীঁছে দেয় বড় বাড়িতে। যেখানে সবাই হুল্লোড় করে মিষ্টি কেনে- মৃদু আহ্বানেই দূর্গার বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে আর বাহির-দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অপু। তার হয়তো ভেতরে যেতে ইচ্ছা করে- দূর্গা যেমন গেছে; কারণ ভেতরে গেলে দূর্গার কপালে যেমন একটা মিষ্টি জুটে যায়, তেমনি অপুর কপালেও জোটার সম্ভাবনা থাকে; কিন্তু অপু যায় না। অপু দরজার বাইরে থেকে দূর্গাদের দেখতে থাকে। অপুকে দেখে মনেহয় যেন আমি নিজেই দাঁড়িয়ে আছি ধনী কোনো আত্মীয়ের বাড়ির বাইরে। ভেতরে যেতে ইচ্ছা করছে, প্রবলভাবে করছে, কিন্তু কী এক অভিমান কী এক বাধা আমাকে কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না- না, কিছুতেই দিচ্ছে না। ফলে আজন্ম দরজার বাইরে, অপুর মতোই, দাঁড়িয়ে রইলাম- এখনো যেমন আছি। ওই দৃশ্যে অপু হঠাৎ স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। অপুর জন্য আমার মায়া হয়, নিজের জন্যেও হয়।

আচ্ছা আরেকটা দৃশ্য আছে না- ওই যে বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। তার আগে বেশ কিছু রুদ্ধ সময় গেছে। বৃষ্টিটা আসে ‘রিলিফ’ হয়ে। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়ে পুকুরপাড়ে অবস্থিত এক লোকের টাকে। এই দৃশ্যটা আমার ভালো লাগে নি; চলচ্চিত্রটির যা আমেজ, এতোক্ষণ পাশ পাশ ধরে যে ছবিগুলো চলচ্চিত্রটা তৈরি করেছে, তার সঙ্গে এই টাকে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার দৃশ্যটি ‘বহিরাগত’ মনে হয়। এতে আমার ভেতর কোনো হাস্যরসও তৈরি করে না- সম্ভবত প্রস্তুত না থাকার কারণেই করে না। তবে পরক্ষণেই দেখি পুকুরভরা বৃষ্টির ফোঁটা। বৃষ্টিতে প্রকৃতির থেকে থেকে কেঁপে ওঠা। আর দেখি অপু-দূর্গার হুটোপুটি ছোটাছুটি... এক সময় জবুথবু হয়ে বৃষ্টিতে ভেজা আর বৃষ্টি ধরে যাওয়ার জন্য ছড়া কাটা। দৃশ্যটা এতো সাধারণ আর স্বাভাবিক যে মনে হয় চলচ্চিত্র নয়, জানালা দিয়ে অপু আর দূর্গার বৃষ্টিস্নান দেখছি। দৃশ্যটির সাথে বারবার নিজেও ভিজে যাই। আবার বৃষ্টিতে ভেজার আকাক্সখাও তৈরি হয়। দূর্গা যখন হাঁচি দেয়, নিজের নাকের কাছেও তখন সুড়সুড় করে শীত অনুভব করি।

আরেকটা খণ্ডদৃশ্য মনে পড়ছে- দূর্গা মারা গেছে। ঝড়-বৃষ্টিতে ভিটে বাড়ি ভেঙে-চুরে-গলে গেছে। অপু তেল আনতে যাচ্ছে। দাওয়া থেকে বাইরে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে অপু ফিরে আসে। তারপর ঘরের ভেতর থেকে একটি ছাতা নিয়ে বের হয়। তেলের বোতল হাতে ঝুলিয়ে, বগলে ছাতা দেবে, অপু চলে যায়।
বৃষ্টিকে অপুর ভয় পাবার কথা নয়- তাহলে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছাতা নেয়া কেন? দিদির মৃত্যু কি তাকে সাবধানী করে তুলেছে? নাকি ওই মৃত্যু তার বয়স বাড়িয়ে দিলো? অপুর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নগুলো খচখচ করে, করতেই থাকে।

‘পথের পাঁচালী’তে বিখ্যাত অনেক দৃশ্য আছে। অপু-দূর্গার প্রথম রেল দর্শন, দূর্গার চুরি করা মালাটা অপুর দেখতে পাওয়া এবং পানা-পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে সত্যটাকে মহাকালের অতলে ডুবিয়ে দেয়া, ভিটে ছেড়ে যাবার পর ঘরের ভেতর সাপের ঢুকে যাওয়া। দূর্গার জন্য বাবার শাড়ি নিয়ে আসা ইত্যাদি। প্রতিটি দৃশ্যই অসাধারণ, খুবই অনন্য। কিন্তু ওপরের ওই সাধারণ দৃশ্যগুলো আমাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে- তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। শৈশবের দিকে ধাক্কা মারছে।
অপু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন