শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

সপুংশক কানাডা


        আমেদ বাজারে ছিল, কেনো ছিল সে জানে না। আলগোছেই বাড়ি থেকে বের হয়ে সে গলিটুকু পার হয়ে বাজারে দাঁড়িয়েছিল। এখন চার রাস্তার মাঝে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। সে যে বোকার মত দাঁড়িয়েছে তাও সে বুঝছে না। রাস্তার পাশের টংচায়ের দোকানে বসা লোকেরাও তাকে পাত্তা দিচ্ছে না, তারা তখন আমলিগ-বেনপি করছে; দেশোদ্ধারের মহান কার্যের ভিতর আমেদ যে গুরুত্ব পাবে না, এটা জানা কথা। আমেদের ভাবনা পরিষ্কার ছিল না তার ময়লা পাজামার মত। যদিও সে পাজামা পরতে চায় নি, কিন্তু কেনো পরেছে সেটা স্পষ্ট নয়। তার গায়ে একটা টি-শার্ট, যা পাজামার সাথে একেবারেই মিলছে। টি-শার্টে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে এফ.ইউ.সি.কে লেখা। টি-শার্টটা আমেদ উপহারই পেয়েছিল, এমন মনে হয়। লিজা বা এলিজা বা এলিটা নামের তরুণী কিছুদিন আমেদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছিল; ওই মেয়েরই প্রবল সম্ভাবনা আছে এ টি-শার্টটি দেয়ার। একদিন শপিংব্যাগ ভর্তি কাপড়-চোপড় নিয়ে আমেদের বাসায় উপস্থিত হয়েছিল সে। বেশ ক’টা টি-শার্ট, পার্টি শার্ট, জিন্স প্যান্ট, আন্ডারওয়ার, রেজর-শেভিং ক্রিম ঘরের মধ্য-মেঝেতে রেখে জানতে চেয়েছিল সব পোশাক গায়ে লাগবে কিনা! আমেদও পরখ ক’রে ক’রে জানিয়েছিল আন্ডারওয়ারটার ঢিলে হওয়ার সম্ভাবনা। বলেছিল মেয়েটার আন্দাজ ঠিক হয়নি। মেয়েটা উল্টো দারুণ কেতায় জানিয়েছিল যদিও সে দেখেনি জায়গাটা.. তবু তার আন্দাজ ভুল হবার নয়। মেয়েটি দেখতে চেয়েছিল। আমেদ তার পুরোনো আন্ডারওয়ার নিয়ে এসে মাপ ধরে দেখিয়েছিল মেয়েটিকে। বোঝাই যায় মেয়েটি তাতে খুশি হয়নি। পরে আরেকদিন দশ প্যাকেট সিগারেট আর বেশ ক’প্যাকেট কন্ডোম নিয়ে এসে মেয়েটি জানিয়েছিল যে এগুলো তার কাজে লাগবে, কারণ সে বাইরে খুব একটা বের হয় না; একা থাকে আর তার বাসায় ছেলের চেয়ে মেয়েরই যাতায়াত বেশি। কথাগুলো যুক্তিযুক্তই মনে হয়েছিল আমেদের; ফলে একটি সিগারেটের প্যাকেট বাইরে রেখে সবগুলো চালান করেছিল ড্রয়ারে। মেয়েটি বলেছিল যে তার এক প্যাকেট কন্ডোমও বাইরে রাখা উচিত। এবং উচিত ভেবেই আমেদ তাও বাইরে রেখেছিল। পরের একটি সপ্তাহেও প্যাকেটটা না খোলায় মেয়েটি দুঃখ পেয়েছিল কিনা আমেদ ভাবেনি; তবে মেয়েটিও আর আসেনি। দু’একবার সেলালাপ হয়েছিল আর তাতে মেয়েটি আমেদকে জানিয়েছিল সে কানাডা চলে যাচ্ছে, নপুংশকের দেশে আর থাকবে না সে। আমেদের নতুন একটা জ্ঞান লাভ হয়েছিল তাতে যে কানাডা সপুংশক অঞ্চল। আর এই জ্ঞান নিয়ে অনেকদিন পর একটা কিছু লিখে ফেলেছিল কবিতার মত সে, বা কবিতাই, বা অন্য কিছু। তাতে আমেদ খুব বিস্মিত হয়েছিল; তার মনে হয়েছিল সে লিখতে ভুলে গেছে। সাদা কাগজ, কম্পিউটারের লেখার সাদা অংশ দেখলে একসময় খুশি হয়ে উঠতো সে, এখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। দ্রুত সে-স্থান ত্যাগ করে। লেখাটি লেখার পর থেকে লিজা বা এলিজা বা এলিটা নামের মেয়েটিকে আমেদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তার মনে হতে থাকে লেখাটি তাকে শোনানো দরকার; যদিও লেখা শোনানোর কাজটি সে কখনোই উপভোগ করেনি। কিন্তু এক্ষেত্রে উল্টোটাই ঘটে যায়। লেখাটি শোনানোর জন্য উদগ্রিবতা পেয়ে বসে; ঝোঁকের মত বা নেশার সমূল টানের মত। সেল ফোনে বারবার চেষ্টা করতে থাকে মেয়েটিকে পাবার জন্য। অপরপ্রান্ত থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের টোন ভেসে আসে; আর সেলফোন সম্পর্কে সীমিত জ্ঞানের কারণে আমেদ বুঝতে পারে না সেলটি বন্ধ থাকছে বা রিঙটা কেটে দেয়া হচ্ছে! আমেদের সেল চেষ্টা চলতেই থাকে। অবশেষে না পেয়ে সে সিগারেটের প্যাকেটগুলোই শেষ করতে পারে মাত্র, আর সপুংশক কানাডাকে তার দূরের মনে হতে থাকে। তবে একটা সন্ধ্যা একটু অন্য রকম হয়ে যায়। ওই মেয়েটা হাতে একটা বোতল নিয়ে হাজির হয়। বোতলটা নাকি উৎকৃষ্ট মদের, মেয়েটা জানায়। আমেদ মদ পছন্দ করে। তবে ঠিক জানে না কোনটা উৎকৃষ্ট আর কোনটা নিকৃষ্ট। মেয়েটি অভ্যস্ত আর বিশ্বস্ত হাতে পাত্রে মদ ঢালে, বরফকুচি ও কোমলপানীয় মিশিয়ে পরিবেশন করলে বলা যায় চমৎকৃতই হয় আমেদ। আমেদ জানায়, সে একটা কবিতা বা না-কবিতা বা অন্য একটা কিছু শোনানোর জন্য তাকে ফোনে খুঁজেছে। প্রত্যুত্তরে মেয়েটি তার ভাঙাচোরা দাঁত নিয়ে হাসে। আমেদ সে হাসিতে, বলা যায়, মুগ্ধই হয়। সিগারেট জ্বেলে মদের পাত্রটা তুলে আমেদ লেখাটা পড়ার উদ্যোগ নিলে মেয়েটা জানায় মদ্যপানের পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে এ লেখাটা শুনতে আগ্রহী। আমেদ লেখাটা রেখে দেয় টেবিলের উপর, অবশ্য তার মনে হতে থাকে টেবিলে কাগজের বদলে সে রেখেছে নিজের হৃদয়। আর এমন মনে হওয়ায় হাসিও আসে তার, তাতে ছলকে যায় মদ, লুঙ্গি ভিজে যায়। মেয়েটি হায় হায় ধরনের উৎকণ্ঠায় আমেদের লুঙ্গি চেপে ধরে, তবে ভিজে যাওয়া অংশের চেয়ে সে অন্যদিকেই মনযোগী হয়ে ওঠে। মেয়েটি লুঙ্গির গেরো ফসকিয়ে আমেদের দিকে একবার তাকায়। জানায় লুঙ্গিটা চেঞ্জ করতে হবে। লিজা বা এলিজা বা এলিটা এবার লুঙ্গি নিচের দিকে নামাতে থাকে যদিও আমেদের বসে থাকার কারণে নামাতে পারে না বেশি, শুধু সামনেটা অনেকখানি উন্মূক্ত হয়ে পড়ে। তাতে মেয়েটা আহলাদিত হওয়ার মত শব্দ করে ওঠে। যেন উপহারে পেয়েছে সোনার অলংকার! সে  উন্মূক্ত দুই উরুতে তার ফ্যাকাসে হাত ঘষতে থাকলে আমেদ উঠে দাঁড়ায়। তাতে অনিবার্যভাবে লুঙ্গিটা নিচে পড়ে, কিন্তু মেঝেতে না প’ড়ে তার কিছু অংশ আটকে থাকে টেবিলের উপর লেখার কাগজটি ঢেকে। আমেদ জানায় তার একটা পোশাক দরকার কিন্তু মেয়েটা তাকে পোশাকহীন দেখতেই আগ্রহী এমন জানালে আমেদের হাতে সিগারেটের ছ্যাঁকা লাগে। অ্যাশট্রে খুঁজে না পাওয়ায় সিগারেটের শেষ অংশটুক আমেদ ধরেই থাকে তার আঙুলের ফাঁকে। আমেদ দুলে উঠলে মেয়েটা তাকে আঁকড়ে ধরতে চায়; তার শরীর থেকে বা নিঃশ্বাস থেকে বা অন্য কোথাও থেকে সুগন্ধ আসছিল যা আমেদের কাছে দুর্গন্ধ বিশেষ মনে হয়। ঘরের দড়িতে টাঙানো একটা পাজামা আমেদ টেনে নেয় পরার জন্য, আর তাতে মেয়েটাকে এমন বিস্মিত মনে হয় যেন একটা বানরকে নিজ উদ্যোগে পোশাক পরতে দেখছে সে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার ফাঁকে আমেদ দেখে তার লেখাটি থেকে লুঙ্গি সরিয়ে মেয়েটা তা ছেঁড়ার চেষ্টা করছে, কম্পিত হাতে তা কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেদ লেখাটির জন্য শোক অনুভব না ক’রে এক ধরনের আনন্দ ঘোরের ভিতর চৌরাস্তায় কানাডা ও নপুংশতা নিয়ে আরেকটি লেখার প্রস্তুতি নিজের ভিতর অনুভব করতে থাকে ।। 

(নতুন ধারা’য় প্রকাশিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন