শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

করমালির একরাত


সন্ধ্যা হবার আগেই রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠেছিলো। তবে করমালি যেদিকে দাঁড়িয়ে, সেদিকে সন্ধ্যাও ঝাঁপ দেয় আগে, বাতিও জ্বলে না। এবং না জ্বলাটাই একধরনের নিয়মের অংশ হয়ে গেছে। করমালি পান চিবাচ্ছিলো, পান চিবানোর সময় নিজেকে তার ছাগলই মনে হয়, বিশেষতঃ থুতনির নিচে আধমুঠোরও কম দাড়ি থাকায়, কিন্তু তবু পানসে চিবায়, চিবানোর ভিতর একধরনের তৃপ্তি পায়। পরনে তার এককালের সাদা, বর্তমানের ধূসর তেলটে পাজামা থাকে বেশিরভাগ দিনেই, আজ অবশ্য কালো রঙের প্যান্ট পরে আছে সে, গত পরশুই এটা সে উদ্ধার করেছে মুনার ঘর থেকে- একটু ঢোলা হয়, কিন্তু খারাপ মানায়নি; সঙ্গে নীলচে শার্টের হাতা গুটানো; বুকের বোতামটা ছেঁড়া ব’লে, এবং আরো একটি বোতাম লাগানোর প্রয়োজন পড়েনি ব’লে বুকের হাড়- খাঁচা চেপে থাকা কর্কশ পশমগুলো দেখা যাচ্ছে, কিংবা করমালি দেখাচ্ছে; এই পশম আর মাথাভর্তি বাবরি চুল নিয়ে তার গর্ব আছে, যা প্রায়ই তার বউ আইশার কাছে জাহির করে। এবং কেবল আইশার কাছেই করে, কারণ অন্যেরা তাকে গ্রাহ্য করে না। আইশাও যে খুব করে তা বলা অসত্যই হবে, মুখের উপর ঝামটি মেরে বলে, ‘মাগিগো শরীল বেইচ্যা খাও… এমন মরদের পশমও দিছে আল্লায়… পশমে তুমার
পুকা লাগবো কইলাম।’ কিন্তু কোনো কোনো রাতে সেই পশম নিয়ে আইশা আহলাদ করে, আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘আমার মদ্দা ঘুড়া।’ করমালি সিনাটা তখন আরেকটু চওড়া করে। এবং আরেকটু জোরে চেপে ধরে আইশাকে। আইশা শব্দ করে হেসে উঠেই সচেতন হয়ে ফিসফিস ক’রে বলে, রূপসা জাইগা জাবো… ডাঙর হইসে না… হে এখনসবই বোজে। করমালিও হুঁসে ফেরে।
       রূপসা মানে রূপসী তাদের সবেধন মেয়ে, আটটি ক্লাস পার ক’রে ফেলেছে পাশের গার্লস হাইস্কুলে, ক’দিন পরেই মেট্রিক না কি দিতে হবে, এইটা পাশ করলে চাকরি একটা নিশ্চিত- বলেছিলেন এনজিও আফা, তারাই নাকি চাকরি দেবে, তখন আর খব্বিশের ব্যবসা কে করে? কিংবা কে জানে হয়তো করতেও হতে পারে; মেয়ে কি আর সারাজীবন থাকবে? এ জন্য একটা পুত্র-সখও ছিলো করমালির। কিন্তু আল্লায় ননা চাইলে কি গাছের পাতাটিও নড়ে?
      করমালি একটু সচেতন হয়, ছোকরা ধরনের একজন এগিয়ে আসছে এদিকে। ছোকরারা খরিদ্দার হিশেবে ভালো, ঝামেলা করেই না বলতে গেলে, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে, মেয়ে বাছাবাছিও করে না তেমন একটা, ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঝামেলা চুকিয়ে চলে যায়, টাকা পয়সা নিয়েও হাঙ্গামা নাইÑ যা চাওয়া যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা-ই পাওয়া যায়। করমালি একটু এগিয়ে যায়। হয়তো জীবনে প্রথম আসছে, সাহস দেওয়ারও দরকার আছে। কতজনকে দেখেছে ঘুরে-ফিরে প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও শুধু সাহসের অভাবে কাম না ক’রে চলে যায়। ছোকরার গায়ে জ্বেল্লাদার শার্ট আর জিনসের প্যান্ট। করমালি বলে,
‘কি লাগবো নাকি?’
ছোকরা এদিক ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হ’য়ে বলে,
আছে?
করমালিও এবার এদিক ওদিক তাকায়, দিনকাল ভালো না, পুলিশকে টাকা দেওয়ার পরও আগে থেকে জানতে পারা যায় না কখন ‘রেট’ হবে, কখন হবে না। ছোকরার কত বয়স হবে? ২২
না ২৩? না, এত কম বয়সের কেউ পুলিশি ঝামেলাওয়ালা হওয়ার কথা না। বলে, আছে।
ছেলেটা জিজ্ঞেস করে, কত?
মানে রেট কত। বাহ্, পাকা মাল মনে হইতাছে, মনে মনে ভাবে করমালি। এবার সেও একটু পেঁচায়,
‘সব রকমেরই আছে। আপনের কেমুন লাগবো?’
‘কড়া… এক নম্বরটা’ ছেলেটা রূমাল বের ক’রে ঘাম মোছে।
‘এই তো ভয় ধরসে’ ভাবে করমালি। এখন এ্যারে সাইজে আনোন লাগবো। বলে, একদম কড়া মালই আছে। কাইলকাই আসছে। এক নম্বুর।
ছেলেটা উৎসাহী হয়ে ওঠে, বলে, ঠিক আছে… চারটা লাগবে। কত আসবে?

চাইরটা? তারপরেই সন্দেহটা গাঢ় হয় করমালির। জিজ্ঞেস করে, চাইরটা? আপনের কি মাল লাগবো? লেডিছ না?
‘কি?’ প্রশ্ন ক’রেই উত্তর পেয়ে যায় ছেলেটা, বলে, না না… বাবা নাই, বাবা?
ভরযৌবনে বাবা মানে গাঁজা বুঝতো করমালি, এখন জানে বাবা মানে ইয়াবা… হিরোইনের মত কইরা খাইতে হয়, পোলা মাইয়া সবেই খায়; মাইয়ারা নাকি খায় কফির লগে মিলায়া, মেলা টাকা দাম। সে জিনিসি চোখেও দেখেনি করমালি। গত ক’দিন ব্যব্সা বেজায় মন্দ। আরো বোধহয় মন্দের দিকেই যাইবো, ভাবে করমালি। আগে মানুষ মদ খাইয়া মাতাল হইয়া মাইয়ামানুষ খুঁজতো- এখন কি সব
নেশা উঠছে… ডাইল, বাবা, মামা, চাচা খাইয়া কোণায় ঝিম মাইরা বইয়া থাকে। কারো খারায়ও না, মাইয়াও লাগে না। কিন্তু ফন্দি আঁটে করমালি, না আঁইটাও উপায় কি? প্যাট
আছে না…!
ছেলেটাকে সে আরেকটু কোণায় টেনে নেয়। ফিসফিস ক’রে বলে, আছে। কড়াটাই আছে। কিন্তুক সাবধান- চারিদিকে ডিবি আর ডিবি- আমার লগে আসেন…
ছেলেটা এবার সত্যিই ভয় পায়। একে এ লাইনে সে নতুন, তাকে যে সাপ্লাই দেয় তার মোবাইল বন্ধ, খোঁজে খোঁজে সে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছে বা আসতে বাধ্য করেছে অমোঘ টান। তার কণ্ঠ আরো নিচে, প্রায় না বলার মত ক’রে বলে, কোথায় যাবো?
করমালি যেন ছোট বাচ্চাকে শাসন করছে এমন ধমকের সুরে বলে, চুপ… কথা কইয়েন না। আমার পিছন পিছন আসেন। কয়টা লাগবো... চাইরটা না?
ছেলেটা করমালি অনুসরণ করতে করতে বলে, হুম।
করমালি রাস্তার ছায়া ছেড়ে একটা গলির ভিতর দিয়ে তার গন্তব্যের দিকে যায়। সরু একটা কলাপসিবল গেটে তালা মারা, গেট খুললেই সিঁড়ি, সিঁড়ির উপরের তিনটা ঘরে বিউটি, মুনা, বেবি, রোজিনারা আছে। করমালি ঠিক করে ছোকরাটাকে বেবির ঘরেই ঢুকিয়ে দেবে, এসব কাজে বেবিই ওস্তাদ, ছোকরার কাছে যা আছে সব বের ক’রে ছাড়বে। অবশ্য তার আগে ওর নিজের
জন্য কিছু হাতিয়ে নিতে হবে। গেটের তালা খুলতেই ছেলেটা বলে, ‘আমি এখানেই দাঁড়াচ্ছি, আপনি নিয়ে আসেন। দাম তো বললেন না?’
করমালি এবার তৈলাক্ত কণ্ঠে বলে, কি কন এইসব? মাথা খারাপ হইছে? এখানে আনোন যাইবো না… আপনি উপরে চলেন, মাল নিয়া যাইবেন গা। আর ভালো মালের দাম তো আপনের জানাই আছে… আপনেরে দেইখাই বুঝছি আপনি পুরান পাবলিক।
কথাটা আনন্দের না, কিন্তু ছেলেটার কেনো যেন আনন্দ হয়, বলে, দাম তো জানাই আছে… আর জিনিসও খুব ভালো চিনি আমি… আমাকে ঠকানোর…
ওরা ভিতরে ঢুকে গেলে আবার গেটে তালা দিতে দেখলে ছেলেটার কথা থেমে যায়। এবার অন্যরকম ভয় অনুভব করে। বলে, তালা দেন কেনো?
‘শালার ডিবিগো কুনো ভরসা নাই’ ব’লে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে করমালি ‘আসেন সমস্যা নাই।’
উপরে উঠে করমালি বেবির ঘরে টোকা দেয়, বেবির হাঁসফাঁস কণ্ঠ ভেসে আসে, কুন জাওরার পুত? করমালি বলে, করম আছি।
ভেতর থেকে বলে, এট্টু খারাইতে ক। হইয়া আইসে…
করমালি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, হে… পাটি আছে। অহনই পাইয়া যাইবেন। চাইর হাজার ট্যাকা দেন।
ছেলেটা বলে, চার কেনো? চারটা আমরা সাড়ে তিনে নিই। আর মাল না দেখে তো টাকা দিবো না।
করমালি বলে, চাইর-ই দেন… আর মাল কড়া কইলাম না…! আপনেরে খারাপ মাল দিয়া আমার কুনো লাভ আছে? খারাপ মাল নিয়া গেলে কি আপনি আর আসবেন? আমি এখানে খারাই আছি না... দ্যান, ট্যাকা দ্যান, আগে ট্যাকা না দিলে আফা মাল দেয় না।
ছেলেটা একহাজার টাকার চারটা নোট বের ক’রে দেয়। করমালি টাকাগুলো দ্রুত পকেটে ভ’রে নেয়। তারপর আবার হাঁক দেয়, কইরে… হইলো?
ভিতর থেকে বেবির চাপা উত্তর আসে, শুয়োরের পুতে ট্যাবলেট খাইয়া আসছে…
পাশের ঘর থেকে মুনার মুখ বেরিয়ে আসে, অল্প বয়সি কালো রঙের একটা মুখ, বলে, ‘করম ভাই আমার ঘরে দেন।’ মুনার জন্য অকারণ দরদ করমালির আছে এ কথা সত্য, কিন্তু এ কাজ মুনার
নয়, এও সে জানে। বলে, তুই পারতি না। এ কাম তোর না। মুনা বড় বড় চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আর তখনই, সেই মুহূর্তেই, মুনার চোখে চোখ পরা মাত্রই, ছেলেটা হঠাৎ ক’রেই, সব কিছু বুঝে ওঠে। সে কাঁপা স্বরে করমালিকে বলে, আমার বাবা লাগবে না... আপনি টাকা ফেরত দেন। আমার
কাজ আছে… আমি যাবো…
শেষ পর্যন্ত ছেলেটি যেতে পায়- কিন্তু করমালির কাছে অবশিষ্ট আরো আড়াই হাজার টাকা, একটি মোবাইল ফোন আর হাত ঘড়িটা রেখে। সেখান থেকে অকারণেই মুনা দু’হাজার টাকা ভাগ পায়।
পেয়ে আনন্দে করমালিকে একটা পান খাওয়ায়। রাত বেশি না হলেও করমালি ঠিক করে আজ সে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবে। আল্লা আইজ দু’হাত ভইরা দিছে... তার ইচ্ছা হয় এই খোশসংবাদ তার
বৌ’রে শোনাতে। মুনার পান চিবাতে চিবাতে সে নিচে নামতে থাকে। বেবির ঘর তখনো বন্ধ। গেটের বাইরে মনতাজ দাঁড়িয়ে আছে। আইজ এইদিকটা হেই সামলাক…পারলে দু’টাকা বেশি কামাক... ভাবে করমালি।
তাড়তাড়ি ফিরবে ভাবলেও তাড়াতাড়ি ফেরা হয় না করমালির, তাকে একবার বাংলা পট্টির দিকে যেতে হয়। এমনি দিনে সাধারণতঃ চোলাই মানে চুল্লু দিয়ে কাজ সারে সে, কিন্তু আজ তো বিশেষ দিন; অভাগা ছোকরাটার কথা ভেবে একটু করুণাও হয় তার, কিন্তু এ করুণা জন্ম পেটে বাংলা মদ পড়লে, মনটা তরল হ’লে। সাদা একবোতল বাংলা পুরোটা শেষ করলে তার ক্ষান্তি আসে, নেশা নেশা লাগে। গন্ধটা পান খেয়েও যাবে না মুখের, অন্ততঃ আইশা ঠিক ধরবে যে সে আজ বাংলা খেয়েছে, অতএব আইশার জন্যও কোনো একটা ব্যবস্থা করা উচিত, ভাবে করমালি।
তাই একবার নতুন বাজারের দিকেও তাকে যেতে হয়, সিটি গোল্ডের একজোড়া বালার দাবি আইশার অনেক দিনের, এ দাবি মেটানোর দিন তো আজই। অতএব দুইজোড়া বালা, অপরজোড়া রূপসার।
রূপসার আবার রসমালাই খুব পছন্দ, তাই নিতে হলো রসমালাইও। ছোকরার মোবাইলটা এখনও তার পকেটে; মোবাইলটা না নিলেও পারতো… কিন্তু কিছু নিয়মের বাইরে যেতে পারে না মানুষ, করমালিও।
মোবাইলটা দিয়ে দিতে হবে আলতুকে। আলতু এসব চোরাইমালের কারবার ভালোই বোঝে… করমালির টাকা নিয়ে কথা, তা যেভাবেই আসুক। পা’টা ভার ভার লাগছে, রাস্তাও মনে হচ্ছে চরাই-
উৎরাইয়ে ভরা… আসলে নেশা, বেশ ঝিম মেরে ধরেছে মাথাটা, একপাশ থেকে অন্যপাশে ঘোরাতে যেন দুইদিন লাগে। তা লাগুক… এমন লাগাতেই তো সে চেয়েছিলো…
আবার একটু আফসোস হয় করমালির ওই ছেলেটার জন্য। তারপর নিজেকেই সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে ওদের বাপের ম্যালা আছে, এমন দু’দশ হাজার টাকা ওদের জন্য কিছুই না।

বাড়িটা তার নিছক বস্তি নয়; যদিও বস্তির পাশে টিন দিয়ে ঘেরা একটিমাত্র ঘর, একপাশে চুলা, অন্যপাশে বেড়া দিয়ে ঘেরা পায়খানা। বছর তিনেক আগে স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যবস্থা ক’রে দিয়ে গেছে।
এইরাত্রে একমাত্র বাল্বটি জ্বলছে ওদের ঘরের ভিতর, বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তবে বস্তির ওইদিকেও আলো আছে- এ সমস্ত আলোর উৎস পাশের কারেন্টের পিলারটা; ওরা খাম্বা বলেই
অভ্যস্ত। তো সেই খাম্বা থেকে লাইন টেনে কারেন্টের ব্যবস্থা করেছে আলতু। এসব ব্যাপারে তার জ্ঞান অগাধ, এবং এই ব্যবস্থা ক’রে দেবার জন্য একশ’টি টাকাও দিতে হয়েছে ওকে, তার খরচ বাদেও; আর পুলিশি ঝামেলাও সে-ই দেখে ব’লে প্রত্যেক মাসে তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ যার কাছে যেমন পারে সে তোলে। করমালির সঙ্গে আলতুর আলগা খাতির, সে তিরিশ টাকাই দেয়। ঘরের দরজায়
একটু হোঁচট খায় করমালি। আইশা তখন চোকির উপর পা তুলে মাথায় তেল ঘষছিলো, স্বামীর দিকে তাকিয়ে, তার হাতের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে, লাল চোখের দিকে তাকিয়ে, আইশা বলে, কামাই
ভালো হইছে মনে লয়… এইজন্যিই কি আগে ফিরলা?
করমালি ঘরে ঢুকে, ঘর খালি দেখে জিজ্ঞেস করে, রূপসা কই?
‘টেনিঙে গ্যাছে গো’ বলে ঠোঁট বাঁকায় আইশা।
‘সাস্থো আফায় আইসা নিয়া গেছে।’
‘কিসের টেরনিং?’ ব্যাগ রেখে চোকিতে বসতে বসতে বলে করমালি। তবে খুব বেশি উদ্যম দেখায় না। কারণ এমন ট্রেনিঙে মাঝে মধ্যেই যায় রূপসীসহ আরো কয়েকজন। স্বাস্থ্য আপা নিয়ে যায়, আবার দিয়েও যায়। কি কি যেন শেখায়- রূপসী এসে প্রথম প্রথম গল্পও করতো; পরিবার পরিকল্পনা, সুস্বাস্থ্য, নিরাপদ পায়খানা, গর্ভকালীন ব্যবস্থা এমন নানান কথা। শুনে করমালির গর্বই হতো কেবল, বুঝতে কিছুই পারতো না। ‘মাইয়ার জন্যি তো রসমালাই আনছি’ করমালি আইশাকে বলে।
আইশা চুলে চিরনি চালাতে চালাতে বলে, মাইয়া আইলে খাইবো… আমার জন্যি তো আর আনো নাই।
‘তোমার জন্যিও আনছি কিছু।’
‘তুমি বাংলা খাইছো নাকি? দেখি, মুখটা কাছে আনো তো!’
‘হ খাইছি। আইজ জবর ইনকাম হইছে রূপসার মা।’
‘নতুন মাগি আইছে নাকি? তুমিও এট্টু টেস্ট করতা…’
‘ধুর… কোন কথায় কি… মাইয়া মানুষ কি আর সাধে কয়? আইজ অন্য ইনকাম হইছে গো…’ ব’লে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে করমালি।
প্যাকেট সে এখনও খোলেনি।
‘হায় খুদা… ছিনতাই করছো?’
‘না গো… দায়ে পইরা দিয়া গেছে।’ গল্প শোনায় করমালি রঙ চঙ মাখিয়ে। নিজের বীরত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে। শুধু মুনাকে টাকার ভাগ দেবার কথা চেপে যায়। সব শুনে প্রথমে খিলখিল ক’রে হেসে ওঠে আইশা, কিন্তু পরক্ষণেই বলে, কামটা ঠিক হইছে কি? অতগুলান টেকা!
‘হ্যাদের বাপের ম্যালা আছে। এ কয়টা টেকা হ্যাদের কিস্যু না- বোজো নাই… মাল খাইতে কত্ত টেকা খরচ করে।’
‘তুমি কয় টাকা করছো?’
‘কিয়ে?’
‘কিয়ে আবার, মাল খাইতে?’
‘বেশি না গো সুনা… বেশি না… আর তুমার জন্যি দেখো সিটি গোল্ডের বালাও আনছি…’
‘সত্যি? কই?’
‘আমি কি আর মিছা কথা কই’ বলতে বলতে বালা বের করে ‘মাইয়ার জন্যিও আনছি, তুমার মাপের একমাপ ছুটো, হইবো না?’
‘খুব হইবো’ ব’লে নিজের বালাদুটো হাতে নেয় সে। আসতে আসতে হাতের ভিতর ঢোকায়।
করমালি চেয়ে থাকে, বলে, ‘যুত হইছে, সোন্দর হইছে।’ মেয়ের বালাজোড়া তার হাতে।
এগুলো দেখিয়ে আইশাকে জিজ্ঞেস করে, কি রূপসার পছন্দ্ হইবো না?
এই সময় বাইরে থেকে অনুচ্চ কিন্তু উৎকণ্ঠিত ডাক আসে, করম ভাই… ও করম ভাই… ডাকের মধ্যে কেমন অজানা আতঙ্কের সুর। এই কণ্ঠ আলতুর, কিন্তু আলতুর এই কণ্ঠ কখনো শোনেনি তারা। করমালি আর আইশার বুক কেঁপে ওঠে। করমালি কাঁপা কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করে, কে… আলতু না… কি হইছে?
‘বাইরে আসো তাড়াতাড়ি…’
বাইরে বেরিয়েই গিয়েছিলো করমালি আর আইশা।
আর বেরিয়েই আলতুর শরীরে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো রুগ্ন ভগ্ন রূপসীকে দেখে দু’জনেই বোবা হয়ে যায়। আলতু অহেতুকই বলে, চুপ। কারণ কেউ কোনো কথা বলছিলো না আলতু ছাড়া। বলে, ভিতরে লও। কেউ দেখে নাই। মেডিকেলের গলির মুখ থেইকা রিকশায় কইরা নিয়া আসছি। কেউ দেখে নাই। কেউ না। ঘরে লও। চুপ।
ঘরে ঢুকেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠতে চায় রপসী। কিন্তু আইশা তীব্র শক্তিতে চেপে ধরে তার মুখ। ওই ফোঁপানির মধ্যেই জানা যায় মটরসাইকেলের  কথা, চারটা পোলার কথা, স্বাস্থ্য-আপা ওকে রাস্তার পাশে রেখে যাবার পরই ওইসব কুত্তার বাচ্চাদের ঝাঁপিয়ে পরার কথা। কিন্তু এসব কেউ শুনতে চায়নি, এসব সকলেরই যেন জানা।
রূপসী কাঁদতেই থাকে, কিছুটা ব্যথায় আর অনেকটা ভয়ে। আইশা মুখ চেপে থাকতে থাকতে ধমকে ওঠে। আলতু বলে, কেউ দেখে নাই তো…
এবার ঘোরটা যেন কাটে করমালির। আলতুর বাহু টেনে নিয়ে যায় একপাশে, বলে, আল্লার দোহাই লাগে আলতু, কেউ যেন না জানে।
আলতু বড়বড় চোখ ক’রে বলে, এইটা কি বললা করম ভাই…! রূপসা আমার মাইয়া না… তারে রিকশায় কইরা সবার নজর বাঁচাইয়া কি আমি আনছি বেবাকরে কওনের লাইগা…!
করমালির তবুও স্বস্তি হয় না, সে রূপসার দিকে তাকায়- মেয়েটা মুখ গুঁজে ফোঁপাচ্ছে তার মায়ের কোলে। করমালি পকেট থেকে মোবাইলটা বের ক’রে আলতুর হাতে দেয়। বলে, ‘ভাইটি আমার জিনিসখান রাখো… আর আর এই টাকাগুলাও’ বলতে বলতে আবারো পকেটে হাত চালায় সে, যা টাকা বের হয়ে আসে তার সবটাই দিয়ে দেয় আলতুকে। ঝড়ে ডানা ভাঙা পাখির মত আর্তি ওঠে তার কণ্ঠে, ‘আলতু, তুমি আমার জন্যি অনেক করছো… আরেকটা উফকার কইরো ভাই… রূপসার এই কথা কারেও কইয়ো না… কারেও না…।’
আলতু মোবাইল টাকা সবই নির্বিঘ্নে নেয় এবং আবারো বলে, রূপসা আমার মাইয়া না… আমি কমু ক্যান…! তুমরা থাহো, আমি বাহিরটা দেইখ্যা আসি…
আলতু চলে যায়। করমালি এবার তার মেয়ের কাছে বসে। পিঠে হাত বুলাতে গিয়েও বুলাতে পারে না, কেনো পারে না, করমালি নিজেও জানে না। শুধু বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, গোসল করাও। অন্য কোনো জামাকাপড় দেও। আইশা তাকিয়ে থাকে তার স্বামীর দিকে, যার বাঁ হাতে তখনো মেয়ের জন্য
নিয়ে আসা বালা দু’টো আলগোছে দুলছে॥


('নতুন ধারা'য় প্রকাশিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন